বীর মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছিত
এই লজ্জা আমরা রাখব কোথায়?
বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়; কিন্তু অতি দুঃখের ও লজ্জাজনক বিষয় সম্প্রতি দেশে এক শ্রেণির মানুষ কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করছেন, মুক্তিযোদ্ধাদেরও নানাভাবে অপমান-লাঞ্ছনা করছেন। তারই একটি নজির দেখা গেল গত রোববার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে।
গতকাল সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। পরে রাতে এ ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভুক্তভোগী ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আবদুল হাই ওরফে কানু (৭৮)। তিনি একজন বীরপ্রতীক। ঘটনাস্থলের পাশের লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। আবদুল হাই কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও একই সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাবেক সহসভাপতি। তার পরিবারের অভিযোগ, লাঞ্ছিতকারীরা সবাই স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। আবদুল হাইকে এলাকা ছাড়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর আবদুল হাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে ফেনীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। গতকাল রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমার বেশি কিছু বলার নেই। মানুষের স্বাধীনতার জন্য দেশ স্বাধীন করেছি; কিন্তু স্বাধীনতার সুফল আজও পাইনি।
চৌদ্দগ্রামের সাবেক আওয়ামী লীগের এমপি মুজিবুল হকের অনিয়ম, অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় আট বছর বাড়িতে আসতে পারিনি। আমার বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছিল। বর্তমান সময়ে ভেবেছিলাম অন্তত বাড়িতে ঘুমাতে পারব। সেই আশা মনে হচ্ছে পূরণ হবে না। তাহলে কার জন্য দেশ স্বাধীন করেছিলাম? এভাবে জুতার মালা পরার জন্য অবশ্যই নয়।’
এ লজ্জা শুধু বীরপ্রতীক আবদুল হাইয়ের একার নয়। এই লজ্জা আমাদের সবার। এই লজ্জা প্রকাশের ভাষা আমাদের জানা নেই। এই দেশের মানুষের মুক্তি যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন আজ তাদের এ কী পরিণতি! তিনি একজন বয়ঃবৃদ্ধ মানুষ, একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে এরকম আচরণ কীভাবে করা সম্ভব!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল এখন তারও দোষের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। তিনি যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন, তার বিচার আইন-আদালতের মাধ্যমে করা যেত। এরকম মব-জাস্টিস কেন? তিনি যদি মুক্তিযোদ্ধা নাও হতেন, একজন সাধারণ মানুষই হতেন, তাও একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে এরকম আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারো সঙ্গেই কাম্য নয়।
কিন্তু আজ দেশ এমনই অধঃপতনের শিকার, কার কাছে কে বিচার চাইবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইও জানিয়েছেন, পুলিশকে বারবার ফোন করেও তিনি কোনো সাড়া পাননি। তাকে যখন অসংখ্য মানুষের সামনে লাঞ্ছনা করা হলো, অনেকেই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছেন, কেউ এগিয়ে আসেননি।
আমাদের নৈতিকতাবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে, তা বলাই বাহুল্য। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই এ ধরনের মব-জাস্টিস চলছে। ঘটনার পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে আবদুল হাই মুক্তিযোদ্ধা বলেই তাকে এভাবে নাজেহাল করা হয়েছে এবং দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ইচ্ছে করেই এটা করা হয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই ঘটনা অতি দ্রুত তদন্ত করে উপযুক্ত বিচার করতে হবে। অপরাধীরা যেই হোক, তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে