বেইলি রোডে আগুন দিল কে?
লিপ ইয়ার, তথা যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস হয় ২৯ দিনে, সেরকম একটি দিন স্মরণীয় হয়ে থাকল অত্যন্ত দুঃখজনক, মর্মান্তিক, বেদনার্ত ঘটনায়। এদিন রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ আগুনে প্রাণ গেছে প্রায় অর্ধশত মানুষের।
ঢাকা শহরে এরকম আগুন এটিই প্রথম নয়। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে লাগা আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে মারা যান আরও প্রায় ৮০ জন। এর এক বছর না যেতেই রাজধানীর বনানীতে এফআর টাওয়ার নামে একটি ভবনে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মুহূর্তেই প্রাণ যায় ২৭ জনের। আহত হন শতাধিক মানুষ।
সর্বশেষ ঘটনাস্থল বেইল রোড। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘গ্রিন কজি কটেজ’ নামে ওই ভবনে ২৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। ওই ভবনে ছিল একাধিক রেস্টুরেন্ট। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে কর্মব্যস্ত মানুষদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে গিয়েছিলেন রেস্টুরেন্টে খেতে। তাদের মধ্যে ছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, যিনি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির নানা বিষয়ে সব সময় সোচ্চার থাকেন। গবেষণা করেন। লেখালেখি করেন। টেলিভিশনে কথা বলেন। তিনিও ওই ভবনে গিয়েছিলেন বড় মেয়ের জন্মদিন পালনের জন্য। কথা ছিল রাত ১২টা বাজার পর সেখানেই কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করা হবে। এ জন্য স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন ওই ভবনের পাঁচতলার একটি রেস্টুরেন্টে; কিন্তু আগুনে আটকে পড়েন।
আগুন লাগার পরে তিনি ফেসবুকে নিজের ওয়ালে স্ট্যাটাস দেন: ‘বেইলি রোডে সপরিবারে আগুনে আমি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ এর কিছুক্ষণ পরে তার স্ট্যাটাস: ‘আমরা এখনো মরে যাইনি। ছাদের ওপর। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। প্রার্থনা করুন। কল করো না।’ তার ঘণ্টাখানেক পরে লেখেন: ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা আমার স্ত্রী সন্তানসহ সব নারী ও সন্তানদের নামিয়ে দিচ্ছি। আমরা সবাই ছাদে আছি। ফায়ারম্যান আমাদের পাশে দাঁড়ালেন।’ এর পরের স্ট্যাটাস: ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা ছাদে থেকে নিরাপদে নেমেছি; কিন্তু অন্য তলায় অনেক হতাহত। সংখ্যাটা শুধু আল্লাহ জানেন।’
তবে অধ্যাপক কামরুজ্জামানের মতো বাকি সবাই এভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে অক্ষত অবস্থায় নামতে পারেননি। যারা পারেননি তাদের বরণ করতে হয়েছে জীবনের শেষ পরিণতি। প্রশ্ন হলো, এই মানুষগুলোর অপরাধ কী? এই মৃত্যুগুলো কি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি সিস্টেম্যাটিক হত্যাকাণ্ড?
ফায়ার সার্ভিস বলছে, প্রচুর গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এনমকি সিঁড়িতেও গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়িটি অগ্নি চুল্লিতে পরিণত হয়। যে কারণে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেননি। ভবনটির আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলেও জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
প্রশ্ন হলো, এই ভবনে এরকম রেস্টুরেন্ট পরিচালনার অনুমতি ছিল কি না? রাজধানীতে এরকম অসংখ্য ভবন রয়েছে, যেখানে মানুষজন পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন, আবার সেখানেই হোটেল রেস্টুরেন্ট আছে। এমনকি পুরান ঢাকার অনেক আবাসিক ভবনের নিচে বা বেজমেন্টে কেমিক্যাল বা অন্য কোনো দাহ্য বস্তুর গুদাম রয়েছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব কার? কীভাবে বছরের পর বছর ধরে এগুলো চলছে? যাদের দেখার দায়িত্ব, তাদের কি লোকবল সংকট, যন্ত্রপাতির অভাব, বাজেট কম, নাকি সিস্টেমের দুর্বলতা?
প্রতিটি ঘটনার পরেই যে তদন্ত কমিটি হয়, সেই রিপোর্টগুলো কতটা আলোর মুখ দেখে? প্রতিবেদনে কী বলা হয় বা সেখানে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়, সেগুলো কেন বাস্তবায়িত হয় না? সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে? বাংলাদেশকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘রোলমডেল’ বলা হয়। যদি তাই হয়, তাহলে বেইলি রোডের ভবনটি আগুনে কয়লা হয়ে গেল কেন এবং কেন প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণ গেল? ফায়ার সার্ভিস তো সময়মতো পৌঁছেছিল?
ভবনগুলো ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে তৈরি হচ্ছে কি না এবং কোন ভবনে কী ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে, সেগুলো দেখা বা তদারকির দায়িত্ব তো রাজউকের। অতএব, বেইলি রোডে যে মানুষগুলো খুন হলেন- তার দায় কি রাজউক নেবে?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় মামলা করেছে পুলিশ। ভবনটিতে থাকা ‘চুমুক’ নামের একটি খাবার দোকানের দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান এবং ‘কাচ্চি ভাই’ নামের আরেকটি খাবারের দোকানের ব্যবস্থাপক জয়নুদ্দিন জিসানকে আটক করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যে ভবন মালিকদের গাফিলতির কারণে এই ধরনের মৃত্যু হয়, তারা কি এই হত্যাকণ্ডের দায় নিতে প্রস্তুত? ধরা যাক, তাদের বিচার হলো। বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি হলো। তারপরেও কি যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের কোনো লাভ হবে? নিহত ব্যক্তি কি আর ফিরে আসবেন? মানুষের জীবন চলে গেলে কোনো কিছুর বিনিময়ে কি সেই শূন্যতা পূরণ করা যায়?
ঢাকা শহরের অধিকাংশ বহুতল ভবনেই যে অগ্নিনির্বাপনের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা নেই; হাইড্র্যান্ট সিস্টেম নেই; বহুতল ভবনে কোনো কারণে আগুন লাগলে দ্রুত ভবন থেকে বের হওয়ার যে উপায় নেই- সেটি বোঝার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। বরং এই লেখাটি যিনি পড়ছেন, তিনি তার নিজের ভবনেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। অর্থাৎ মানুষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক বহুতল ভবন বানাবেন; কিন্তু সেখানে যারা থাকবেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা হবে না।
যিনি এই লেখাটি এখন পড়ছেন- আপনি একটু অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন যে, আপনার ভবনের বৈদ্যুতিক লাইন কতটা নিরাপদ। আপনার বাসার গ্যাস লাইন কিংবা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করলে তার ব্যবস্থাপনাটি কতটা আধুনিক। কতটা সুরক্ষিত। আপনার ভবনের এসিগুলো কতটা ঝুঁকিতে আছে। গরম আসছে। এসির ব্যবহার বাড়বে। ফলে এসির দুর্ঘটনায় আগুনের ঘটনাও বেড়ে যেতে পারে; কিন্তু আপনার নিজের বাড়ির এসি ঠিকঠাক আছে কি না, সেই খোঁজটিও কি আপনার কাছে আছে?
যে মা তার সন্তানকে হারালেন- কোটি টাকার ক্ষতিপূরণেও কি ওই মায়ের মনকে শান্ত করা যাবে? যে লোক তার স্ত্রীকে, যে স্ত্রী তার স্বামীকে, যে সন্তান তার বাবাকে এবং যে মা তার ছেলেকে হারিয়েছেন, তাদের কি কোনো ক্ষতিপূরণ হয়? পৃথিবীর সব সম্পদ একত্র করলেও কি একজন সন্তানহারা মায়ের অশ্রুর সমান হবে?
‘জন্মমৃত্যু আল্লাহর হাতে’- এই সান্ত্বনার ভার বইতে হবে সারা জীবন? এখানে রাষ্ট্রের কী দায়? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের মালিকদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবহেলার জন্য যাদের মৃত্যু হলো, তারা কি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হবেন? তারা কি মানুষ হত্যার দায়ে শাস্তি পাবেন? পাবেন না। কেননা অতীতে এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে। তার ফলাফল বা পরিণতি কী হয়েছে তা দেশবাসী জানে। বরং খুব দ্রুতই আরেকটি বড় ঘটনা ঘটলে বেইলি রোডের লেলিহান আগুনের শিখা মানুষের মন থেকে ফিকে হতে থাকবে। হয়তো এর চেয়ে আরও বড় কোনো ঘটনা এই ঘটনাকে ম্লান করে দেবে। তখন আবারও টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ হবে। সংবাদপত্রে বিশ্লেষণ প্রকাশিত হবে। সমাজের সচেতন মানুষরা প্রতিবাদ করবেন। লিখবেন। টেলিভিশনের পর্দায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবেন; কিন্তু তারপর কী? যে দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের কারণে বারবার এই ঘটনাগুলো ঘটছে, সেই সিস্টেম কি বদলাবে? বলা হয়, রাজধানী ঢাকার মানুষ মূলত একটি অ্যাটম বোমার ওপরে বসবাস করে এবং এত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর বিশৃঙ্খলার ভেতরে এই শহরে বেঁচে থাকাটাই যেন এখন ‘মিরাকল’।
অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডে যারা মারা যান, তাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। দেশের কোনো খ্যাতিমান লোক, কোনো রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতা, কোনো আমলা, কোনো বড় ব্যবসায়ী এসব আগুনে পুড়ে নিহত হননি। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা তাদের আগুনে পুড়ে মৃত্যু কামনা করছি; কিন্তু এটিই নির্মম সত্য যে, বারবার এ সব ঘটনায় সাধারণ মানুষেরই প্রাণ যায়। কারণ ‘অসাধারণ মানুষেরা’ সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এমন সব পদ্ধতি তৈরি করে রাখেন, যাতে করে তারা নিজেরা পুড়বেন না; বরং পুড়বে সেসব মানুষ যারা তাদের কারখানা পাহারা দেবে। যারা তাদের কারখানায় উৎপাদন করবে। যাদের উৎপাদনে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে। রপ্তানি আয় বাড়বে। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ কথাটি বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে যাবে।
বেইলি রোডে কেন এই ঘটনাটি ঘটলো কিংবা এর আগে নিমতলী, চুড়িহাট্টা, মগবাজার, রূপগঞ্জ, সীতাকুণ্ডসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ আগুনে কেন বারবার এরকম নিরীহ মানুষের প্রাণ যাবে? নিমতলীর ঘটনার পর যে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল, সেই একই আলোচনা ২০ বছর পরও কেন করতে হচ্ছে? এই ২০ বছরে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কী করল? রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আমদানির পর যেসব জায়গায় কেমিক্যাল মজুদ করে রাখা হয়, সেগুলো কতটা নিরাপদ? ব্যবসায়ীরা কতটা নিয়ম-কানুন মানেন। এর জন্য কি কোনো নীতিমালা বা গাইডলাইন আছে? তার মানে দিনের পর দিন এসব অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকলেও তা বন্ধ হয় না। কারণ প্রতিটি ঘটনার পরেই তদন্ত কমিটি হয় এবং সেই কমিটি যেসব সুপারিশ করে, তা বাস্তবায়ন হয় না।
রাষ্ট্রের কাছে যে মৃত্যুগুলো নিছকই সংখ্যা- নিহতদের পরিবারের কাছে সেগুলো সারা জীবনের শূন্যতা, যন্ত্রণা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী যে ব্যক্তিটি মরে গেলেন; রাষ্ট্রের যে দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম বা দুর্বলতার কারণে যারা প্রকৃতপক্ষে খুন হলেন, সেইসব পরিবারের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নিয়েছে কখনো?
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে