কারা হবেন বিরোধী দল?
আগামী ৩০ জানুয়ারি বসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। ইতোমধ্যে সরকার গঠন হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ স্পিকার, মন্ত্রিসভা, ডেপুটি স্পিকার একরকম নির্ধারণও হয়ে গেছে। যদিও ৩০ জানুয়ারিই আনুষ্ঠানিকভাবে স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন; কিন্তু ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার হিসেবে শামসুল হক টুকুকে মনোনয়ন দিয়েছে। এ নিয়ে কোনো বিরোধিতা বা অন্য কোনো প্রার্থীর সম্ভাবনাও নেই। তবে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বিরোধী দল কারা হবে। বিষয়টি জটিল হয়ে আছে বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি জটিল হওয়ার কারণে। বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। এসেছে জাতীয় পার্টি। তাদের ফলাফল আশাব্যঞ্জক হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নিয়ম হলো, একাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
ওয়েস্ট মিনিস্টার সিস্টেমে সর্বাধিক আসন পাওয়া দলকে আহ্বান জানানো হয় প্রথমে সরকার গঠনের। যদি তারা কোনো কারণে অপারগ হন সরকার গঠন করতে, তাহলে এক বা একাধিক দল মিলে সরকার গঠন করতে পারে, যাকে আমরা মাইনরিটি গভর্নমেন্ট বলে থাকি। এরকম সরকার অনেক দেশে দেখা গেছে। আর যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়, তখন নির্বাচিত দ্বিতীয় বৃহত দল বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বিরোধী দল থাকতেই হবে, না হলে সরকার গঠন হবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অন্তত আমাদের সংবিধানে এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। কেবল সংসদ কার্যপ্রণালি বিধিতে বিরোধীদলীয় নেতা কথাটি উল্লেখ আছে; কিন্তু সেটা কিতাবের কথা। বাস্তবে বিরোধী দল না থাকলে পার্লামেন্ট তাৎপর্যপূর্ণ হয় না।
প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশেই একটি বা একাধিক বিরোধী দল থাকে। কোথাও কোথাও একাধিক বিরোধী দল থাকলে বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দলপ্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হয়। অথবা একাধিক দল মিলে বিরোধী আসন অলংকৃত করেন। আমাদের দেশেও আগে তাই হয়েছে। একটি বিরোধী দল দেশের মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন। প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হ্যারল্ড লাস্কির মতে, ‘মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্ক করবে।’ এই স্থানই হলো পার্লামেন্ট। বিরোধী দল না থাকলে ওই পার্লামেন্টের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, দুবার বাংলাদেশে সংসদে বিরোধী দল ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩ টি আসন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
বাকি ৭টির মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১টি এবং স্বতন্ত্র পেয়েছিল ৫টি। তখন বিরোধী দল হিসেবে গঠিত হওয়ার মতো সক্ষমতা না থাকায় তারা বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হননি; কিন্তু তাদের জন্য সংসদে একটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায়। দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ সালে বিএনপির ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর করা সরকারে কোনো দলই সংসদে যায়নি; কিন্তু দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল হবে কারা, তা নিয়ে সারা দেশে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এর কারণও আছে। হিসাব অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছে। ২৯৯টি আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৫টি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ৬১ এবং জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। অর্থাৎ দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
কোনো কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেছেন, আমাদের মধ্যে একটি মোর্চা তৈরি করে বিরোধী দল গঠনের চেষ্টা চলছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোর্চা তৈরি করলে কি তা বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? কারণ তাদের কোনো রাজনৈতিক দল নেই। দ্বিতীয়ত, স্বতন্ত্র যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৫৬ জনই আওয়ামী লীগের। তাদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগ দলের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। তারা মোর্চা করে বিরোধী দল গঠন করতে পারেন কি? কারণ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে ফে।লার ক্রস করতে পারবেন না, অর্থাৎ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট বা মত দিলে তারা শুধু দলের পদ হারাবেন না, সঙ্গে সংসদীয় পদও হারাবেন। আবার অন্য বক্তব্যও আছে।
বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু স্বতন্ত্র বিজয়ীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেননি, সেহেতু তাদের বিরোধী দল হতে কোনো বাধা নেই এবং এক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। এ নিয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা কারও নেই। কারণ প্রতীক নিয়ে তারা নির্বাচন না করলেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি, সংগঠন থেকে ইস্তফা দিয়ে তারা নির্বাচন করেননি। তারা আওয়ামী পরিবারের সদস্য। এমনকি তারা নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচিত হয়েও কেউ আওয়ামী লীগের কোনো পদ ত্যাগ করেননি। এই সদস্যরা যদি একটি মোর্চা গঠনও করেন, তাতেও তারা বিরোধী দল হিসেবে কোনো ইমেজ তৈরি করতে পারবেন না। আর রাজনৈতিক নানা বাস্তবতার কারণে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অর্থাৎ নিজেদের দলের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা বা কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না।
আবার অন্য একটি সমস্যাও আছে। তাদের একটি মোর্চা করতে হলে অন্তত ২৫ জন সদস্য প্রয়োজন হবে। তারা জোটবদ্ধ হলে স্পিকার একটি রুলিং দেবেন। অবশ্য ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ৩৪টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল গঠন করলেও তখন ১৬ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নিয়ে একটি জোট গঠিত হয়েছিল। তবে বর্তমান বাস্তবতায় মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করছে বিরোধী বেঞ্চে কারা বসবেন সেটা। তবে দেশের মানুষ হিসেবে আমরা চাই একটি পরিষ্কার বিরোধী দল থাকুক, যারা সরকারের নানা সমালোচনা করে মানুষের সামনে সরকারের দুর্বলতা এবং দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনগুলো তুলে ধরতে পারেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে