Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মার্কিন নির্বাচনে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী যে কারণে পরাজিত হতে পারেন

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে আগামী ৫ নভেম্বরে ভোট দেবেন সে দেশের নাগরিকরা। আর সেই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী কিন্তু বিজয়ী নাও হতে পারেন। মার্কিন গণতন্ত্রের আলাদা কিছু দিক রয়েছে, আর সেগুলো নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের গণতন্ত্রকে অনুকরণীয় হিসেবে দেখিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে, স্বাধীনতা অর্জনের পরে কিংবা স্বৈরশাসককে সরিয়ে দেয়ার পর গণতন্ত্র পুনর্গঠনে কোনো দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র উদাহরণ হতে পারে। আজকের ডেমোক্র্যাটরা যেখানে বহুজাতিগত গণতন্ত্রের ধারণাকে গ্রহণ করছেন, সেখানে রিপাবলিকানরা পুরোনো শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকে পুনরুজ্জীবিত করে দেশকে আবার মহান করতে চাচ্ছেন। ফলে বহু জাতির গণতন্ত্রের ধারণা এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ধারণা এখন সাংঘর্ষিক মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগেও এই সংঘাত ছিল। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের বেশির ভাগই রিপাবলিকান প্রার্থীদের ভোট দিয়ে আসছেন। এর কারণ হলো, সেই বছর ডেমোক্র্যাটিক নেতা লিন্ডন বি জনসন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর তিনি নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার আইন পাস করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন আনে। এই আইনের কারণে অশ্বেতাঙ্গদের অনেক নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়, যা শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ক্ষুব্ধ করে। ওই আইন পাসের পর অনেক শ্বেতাঙ্গ এবং রক্ষণশীল ভোটার রিপাবলিকান পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েন। পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘গণতন্ত্রের সংকট’ বাড়ছে। এর পেছনে মূলত আর্থিক বৈষম্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাঙন এবং গণঅভিবাসনের রাজনীতি কারণ হিসেবে কাজ করছে। তবে এই সংকটের আরেকটি বড় কারণ হলো জনমিতিক গঠন।

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে যে জনমিতিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা পশ্চিমা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। যেহেতু জনমিতিক প্রবণতা সহজে বদলানো যায় না এবং যেহেতু এই প্রবণতা আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেহেতু এই বিশৃঙ্খলা দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই লড়াইয়ে ফয়সালা হবে, আমেরিকায় গায়ের চামড়ার রং বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যভিত্তিক ঐতিহাসিক জাত-পাতের শ্রেণিবিন্যাসের বিলুপ্তি হবে নাকি যুক্তরাষ্ট্র শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকেই এগিয়ে যাবে।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে থাকা ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন লাভ করেন। এতে মূলত শ্বেতাঙ্গ-নির্ভর কৌশল আরও জোরালো হয়। ট্রাম্প যদি আরেক দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে আমেরিকার ঐতিহাসিক জাতিগত ও রাজনৈতিক শ্রেণিভেদ পুরোদমে মাথাচাড়া দেবে, যা সংঘাত বাড়িয়ে দেবে। কারণ, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় কয়েক মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করার কথা রয়েছে। তবে ট্রাম্প পরাজিত হলে এই সংঘাত একেবারে থেমে যাবে, এমনও নয়। এটি চলতেই থাকবে। কারণ, ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ আদর্শ এখন রিপাবলিকান পার্টির মূল চিন্তাধারায় মিশে গেছে। ২০১২ সালে ওবামা পুনরায় নির্বাচিত হলে, রিপাবলিকান পার্টি বুঝতে পারে, তাদের সংখ্যালঘু ভোটারদের দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। এ জন্য রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল; কিন্তু অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে তারা বিপরীত পথে হাঁটতে থাকে। তারা শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের আকর্ষণ করতে এমন সব পদক্ষেপ নেয়, যা সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটাধিকারকে সংকুচিত করে এবং কংগ্রেসনাল এলাকাগুলোকে বর্ণভিত্তিকভাবে পুনর্বিন্যাস করে।

২০০৮ সালে যখন বারাক ওবামা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের একটি বড় অংশ মার্কিন জনসংখ্যার বৈচিত্র্য এবং তার প্রভাব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এটি অনেকের কাছে সামাজিক উন্নতির প্রতীক হলেও কিছু মানুষের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ছিল শ্বেতাঙ্গ। বর্তমানে এই সংখ্যা ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০৪৪ সালের মধ্যে তারা মার্কিন জনসংখ্যার ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করবে। রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় দিক থেকে এই পরিবর্তন বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক ও অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় এখনো আমেরিকান শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যায় অনেক বেশি; তথাপি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা সেখানে রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের রাজনৈতিক প্রভাব কমে এসেছে। এ কারণে তাদের মধ্যে অবস্থান হারানোর অনুভূতি ও কোণঠাসা হওয়ার ধারণা তৈরি হচ্ছে।

গবেষণা বলছে, ৬০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে ‘নিজ দেশে পরবাসী’র অনুভূতি কাজ করছে। একটি রাজনৈতিক দল যদি তার ভবিষ্যতের জন্য এমন জনগণের ওপর নির্ভর করে, যে জনগণের রাজনৈতিক প্রভাব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে সেই নির্ভরতাকে আত্মহত্যার শামিল বলে মনে হতে পারে। অবশ্য অর্থনৈতিক উন্নতির বার্তা প্রচারের ফল হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিপাবলিকানদের প্রতি অশ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন বেড়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলাট উল্লেখ করেছেন, মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সংখ্যালঘুদের শক্তি বাড়াতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে তৈরি করা হয়েছিল। যেমন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পপুলার ভোট নয়, বরং ইলেক্টোরাল কলেজকে গুরুত্ব দেয়া হয়।

এভাবে ২০১৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে পপুলার ভোট কম পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সুবাদে ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। একইভাবে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য তার জনসংখ্যা নির্বিশেষে সিনেটে দুটি আসন পায়। অর্থাৎ যে অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা অনেক বেশি, সেখানেও দুটি আসন এবং যে অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যায় অনেক কম, সেখানেও দুটি আসন। ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ আমেরিকান মাত্র ১৫টি অঙ্গরাজ্যে বাস করবে। সিনেটে এই ৭০ শতাংশ মানুষের জন্য থাকবে ৩০ জন প্রতিনিধি।

অন্যদিকে বাকি অঙ্গরাজ্যগুলোতে বাস করা ৩০ শতাংশ মানুষের জন্য সিনেটে প্রতিনিধি থাকবে ৭০ জন। জনমিতিক প্রবণতা, ট্রাম্পপন্থি রিপাবলিকান দল এবং সংবিধানের অজনপ্রিয় বিধিবিধান-এই সব মিলেঝিলে আগামী বছরগুলোতে আমেরিকার গণতন্ত্রকে অত্যন্ত বিশৃঙ্খল করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিগুলো স্বৈরতন্ত্র থেকে সুরক্ষা দিতে পারে বটে; তবে মনে হচ্ছে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকানরা কি কেন্দ্র পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবে এবং চরমপন্থি ডান ও বামপন্থিদের কোণঠাসা করতে পারবে? শিগগিরই তা মনে হচ্ছে না। এই বছরের নির্বাচন কোনো সহজ জয়-পরাজয়ের সমাধান দেবে না। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যদি জয়ী হন, তাতেও আমেরিকার গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে রক্ষা পাবে না, আবার ট্রাম্প জয়ী হলে সেটিও গণতন্ত্রকে রাতারাতি ধ্বংস করবে না। বরং এটি হবে এক দীর্ঘমেয়াদি জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘাতের আরেকটি অধ্যায়, যা প্রায় ছয় দশক আগে শুরু হয়েছিল এবং এখনো যার শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

আমেরিকানদের এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি খুব বেশি আস্থা নেই। তারা এমন একটি কংগ্রেসের দিকে তাকিয়ে আছেন, যা মোটেও ঠিক মতো কাজ করছে না। এবং তারা এমন কিছু জটিল সমস্যা দেখছেন, যা সরকার আসলেই সমাধান করেনি। যেমন আগ্নেয়াস্ত্রকেন্দ্রিক সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তন।

নেতা নির্বাচনে নিজেদের অক্ষমতার কারণে প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান ২০২৩ সালের অক্টোবরে কয়েক সপ্তাহের জন্য কংগ্রেসকে পঙ্গু করে দিয়েছিল; কিন্তু এমন বাধা ছাড়াই কংগ্রেসের হাউস বা সিনেট থেকে আইন প্রণয়নের মতো জরুরি বিষয়গুলোও চলছে ধীরগতিতে। ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে এক সাগর দূরত্ব-এর অর্থ হলো, নির্বাচিত সরকারের নেয়া অনেক সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট থাকে দেশের অর্ধেক। ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল নিয়ে ট্রাম্পের নেতৃত্বে অনেক রিপাবলিকান বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তারা দাবি করেছেন, নির্বাচনে তাদের উপেক্ষা করার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি, নির্বাচনটি তাদের কাছ থেকে চুরি করেছে বলেও দাবি ছিল তাদের। ফলে ক্যাপিটল ভবনে আক্রমণ করতেও পিছপা হয়নি তারা।

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর গণতন্ত্রণের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনার নজির নেই বললেই চলে। ভোটে জয়ী হওয়াই মুখ্য নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে গেলেও তা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশে এমনটা হয়তো কেউই আশা করেন না। গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার সাম্প্রতিক উদাহরণগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্রবিরোধী চর্চা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে সর্বাধিক ভোট পাওয়া যথেষ্ট নয়। প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট পেতে হয়। ফলে জনগণের ভোট কেউ বেশি পেলেও, ইলেক্টোরাল ভোটের কারণে কম ভোট পাওয়া প্রার্থী দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন।

রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ