Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আল-শাবাব কেন সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে যোগ দিল

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ৩১ দিন পর বাংলাদেশী পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ও এর ২৩ নাবিক মুক্তি পেয়েছেন। গত ১২ মার্চ কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে ২৩ নাবিকসহ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এই জাহাজটির মালিক বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপ।

মুক্তির পর জলদস্যুরা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটি চিঠি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, জাহাজটি নিরাপদে দুবাই যেতে পারবে, পথে অন্য জলদস্যুরা আটক করতে এলে তাদের এই চিঠি দেখালে ছেড়ে দেবে। তারপরও জাহাজটিকে স্পেন ও ইতালীয় নৌ বাহিনী পাহারা দিয়ে ভারত মহাসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রমে সহায়তা করেছে। জাহাজ মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর উত্তর-পূর্ব সোমালিয়ার ফেডারেল রাজ্য পুন্টল্যান্ডের পুলিশ ৮ জন জলদস্যুকে গ্রেপ্তার করেছে। মুক্তিপণ দেওয়ার কথা কেউ স্বীকার করছে না, কিন্তু মুক্তিপণ ছাড়া জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি পাওয়ার কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

৬৫ জন জলদস্যু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাহাজটি আটক করেছিল। তারা বাণিজ্য জাহাজ ভেবে মাঝে মাঝে যুদ্ধ জাহাজে আক্রমণ করে জীবন খোয়ায়। তাই মুক্তিপণ আদায় না করে কোনো জিম্মি করা জাহাজ মুক্তি দেওয়ার নজির নেই। একটি ভিডিওতে দেখা গেল সাগরে কতগুলো প্যাকেট নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং কিছু লোক দুটি স্পিডবোটযোগে সেই প্যাকেট কুড়িয়ে নিচ্ছে। জলদস্যুদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, মুক্তিপণ হিসেবে ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি বীমা প্রতিষ্ঠান এই অর্থ পরিশোধ করেছে। কুড়িয়ে নেওয়া প্যাকেটের অর্থ আসল-নকল যাচাই করার পরই জলদস্যুরা জিম্মি করা জাহাজ, নাবিক ও ক্রুদের মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু এভাবে মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি লাভ জলদস্যুদের উৎসাহিত করবে। ভারতীয় এবং ইউরোপের যুদ্ধ জাহাজগুলো শক্তি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের নাবিকদের উদ্ধারের অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু নাবিকদের জীবনহানির আশঙ্কায় অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা থাকায় দস্যুরা কিছুটা চাপে ছিল বলেই দ্রুত সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে।

সোমালিয়ার ৯৯ শতাংশ লোক মুসলমান। ১৯৬০ সনে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পায় সোমালিয়া। ১৯৯১ সনে সামরিক শাসনের উৎখাত হলে পরের দুই দশকের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তখন আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে ট্রলার নিয়ে এসে জেলেরা সোমালিয়ার উপকুল থেকে মাছ ধরে নিয়ে যেত, প্রতিবাদ করলে গুলি ছুঁড়ত। বিদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও ছিল না সোমালিয়ার। বিদেশি জেলেদের প্রতিরোধ করতে গিয়েই সোমালিয়ার গরীব, নিরীহ জেলেরা ক্রমান্বয়ে জলদস্যু হয়ে ওঠে। সোমালিয়ার গরীব জেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে বিদেশি মাছ ধরার ট্রলার ও জাহাজকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে শুরু করে। মাছ ধরার ট্রলার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতে করতে এক সময় এই গরীব জেলেরাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য জাহাজ জিম্মি করতে শুরু করে এবং এর মাধ্যমে অধিক মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব হয়।

বর্তমানে এদের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে সোমালিয়ার সশস্ত্র ইসলামপন্থী আল-শাবাক গোষ্ঠী। সোমালিয়ার জলপথে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার জাহাজ চলাচল করে। ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে এটিই সবচেয়ে ছোট সামুদ্রিক পথ। সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায় ২০০৫ সন থেকে। ১৪ বছর আগে বাংলাদেশের একই মালিকের আরেকটি জাহাজও একইভাবে মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের জিম্মি থেকে ৯৯ দিন পর মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। ২০১১ সনে বিভিন্ন দেশের ৩১টি এবং ২০১২ সনে ৮টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে জলদস্যুদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। ২০১১ সনে প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন এবং ২০১২ সনে লেগেছে ৩১৬ দিন। মালয়েশীয়ার একটি জাহাজের মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল ৩ বছর এবং মিয়ানমারের মাছ ধরার একটি জাহাজ মুক্ত হয়েছিল ৫ বছরের মাথায়, এই সময়ে ৬ জন নাবিক অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

জিম্মি অবস্থায় জলদস্যু ও জিম্মি নাবিকদের খাবার সরবরাহ করার কোম্পানিও আছে, পরে মুক্তিপণ থেকে একটি অংশ তারা পায়। জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক কোম্পানি নিজেদের জাহাজে সশস্ত্র লোকের পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে, কিন্তু এতে পণ্যের পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। এই অবস্থায় জলদস্যুদের প্রতিহত করতে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয় এবং এই তৎপরতায় ২০১৩ সন থেকে বহু বছর ধরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিষ্কৃয় ছিল; কিন্তু এখন ইয়েমেনের হুথিদের আক্রমণ মোকাবিলায় পশ্চিমা শক্তি বেশি নিবিষ্ট থাকায় সোমালিয়ার জলদস্যুরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেছে।

সোমালিয়া আফ্রিকার একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। ২০০১ সনে ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হরকাত আল শাবাব আল মুজাহিদিন সংক্ষেপে আল-শাবাব গঠিত হয়। ২০০৬ সনে সংগঠনটি তাদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে এবং সোমালিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও কেনিয়ার সামরিক জোটকে পরাজিত করে রাজধানী মোগাদিসুসহ বিভিন্ন শহর ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপের সহযোগিতায় কেনিয়া পশ্চিমা সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের পক্ষে ২০১১ সনে সেনা প্রেরণ করলে আল-শাবাব গোষ্ঠী পেছন হটতে বাধ্য হয়। আল-শাবাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হামলা চালাচ্ছে; এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোও আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনীর অংশ হিসেবে ২০১২ সনে শাবাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সোমালিয়ান সরকার এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথবাহিনীর কাছে অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আল-শাবাব চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, অর্থের জন্য জলদস্যুদের সাথে সম্পৃক্ত হয়।

চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ার পর আল-শাবাব তাদের যাবতীয় খরচ মেটায় সশস্ত্র দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে। জলদস্যুদের ২০ শতাংশ এই সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য। তাদের অধিকৃত এলাকায় কঠোর শরিয়া আইন বলবৎ করলেও তাদের আয়ের প্রধান উৎস শরিয়া বিরোধী অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ও নারী পাচার। আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় আফগানিস্তানের তালিবানদেরও আয়ের প্রধান উৎস ছিল মাদক ব্যবসা। সশস্ত্র জেহাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় সকল ইসলামপন্থী সংগঠন অবৈধ আয়কে বৈধতা দিয়ে থাকে। আল-শাবাবের অবশ্য বৈধ আয়ও আছে। তারা তাদের অধিকৃত এলাকা থেকে শুল্ক ও কর আদায় করে, তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার সড়ক, সেতু থেকে টোল আদায় করে, তারা ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ কর্পোরেট যাকাত আদায় করে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা চাকরিজীবীদের বেতন থেকে ৫ শতাংশ কর্তন করে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।

সোমালিয়ায় শরিয়া আইন বলবৎ থাকা সত্বেও আল-শাবাব নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থীরা সোমালিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। আফগানিস্তানের আইএস-এর মতো আল-শাবাবও জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারকে মেনে নিতে পারছে না। আল-শাবাব সউদি আরবের ওহাবি আদর্শে বিশ্বাসী হলেও আন্তর্জাতিক জিহাদের অংশ হিসেবে তারা আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে। আল-কায়েদার মতো আল-শাবাবও পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থে আঘাত করার জন্য সুযোগ খোঁজে। পশ্চিমের দেশগুলোও আল-শাবাবের উপর আক্রমণ চালায়, ২০০৮ সনে বিমান হামলা চালিয়ে আল-শাবাবের প্রধান মুয়ালিম আদেন হাশি আইরোকে হত্যা করে।

দেশের চরম দারিদ্র সোমালিয়ার যুবকদের আল-সাবাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গোষ্ঠীটি সোমালিয়া ও কেনিয়ার বহু মেয়েকে আটক করে যৌনদাসী বানিয়েছে যাতে যৌনদাসীদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়ে ইসলামিক যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়। আল-শাবাব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক নানামুখী উদ্যোগের পরও সোমলিয়ার জলদস্যুদের সম্পূর্ণ নিবৃত্ত করা সম্ভব হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের ৭২ গ্রুপের একটি শেয়ারবাজার আছে, মুক্তিপণ থেকে অধিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় এই শেয়ারবাজারে প্রচুর বিনিয়োগ হয়। সোমালিয়ার উপকুল এত বিস্তৃত যে, সারাক্ষণ জলদস্যুদের পাহারা দিয়ে শঙ্কাহীন নিরাপদ বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্ন রাখা কঠিন; এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সোমালিয়ান সরকারের জল ও স্থলপথে জলদস্যুদের উচ্ছেদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই যথাযথ পদক্ষেপ বলে মনে হয়।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক এমডি, টাকশাল।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ