বইমেলায় বই বিক্রি এত কম কেন?
অমর একুশে বইমেলার বয়স ৫২ বছর হলো। এর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২ হাজার ৬৮৭ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে গত বছর জানা গিয়েছিল, দেশে বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৪ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত, যাদের দৈনিক আয় ২ ডলার থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনোদন মাধ্যমের আকার সবই বছর বছর বাড়ছে। বাড়ছে বাজারের খাবারের দোকান, শপিং মল, পিকনিক স্পট, ট্যুরিস্ট স্পট। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যেরই চাহিদা বাড়ছে হু হু করে। বাড়ছে না কেবল বইয়ের চাহিদা। এক মাস ধরে যে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন হয়, ৫২ বছরে সেই বইমেলার বিক্রির পরিমাণ কখনো ১০০ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করেনি, যা দেশের জন্য অনভিপ্রেত।
বইমেলা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২৯ তারিখে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকাশকদের অনুরোধে ২ দিন বাড়ানো হয়। ফলে ফেব্রুয়ারির বইমেলা মার্চের ২ তারিখ পর্যন্ত গড়ায়। এবারের বইমেলা ৩১ দিন ধরে আয়োজিত হয়। বাংলা একাডেমির উপপরিচালক শাহেদ মমতাজ অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় বই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি টাকা।
অমর একুশে বইমেলায় সর্বোচ্চ বই বিক্রির রেকর্ড ৮২ কোটি টাকা, যা হয়েছিল ২০২০ সালে, করোনার আগে। ২০২১ সালে মহামারির কারণে বইয়ের বিক্রি কমে মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ টাকায় নেমে আসে। ২০২২ সালে করোনা-পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ কোটি ৫০ লাখে; কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত কোনো রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক মহামারির কারণ ছাড়াই ২০২৩ সালে বই বিক্রি কমে টাকার অঙ্কে নামে ৪৭ কোটি টাকায়। এবার বই বিক্রির পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও আশানুরূপ ছিল না বলে অনেক প্রকাশক মন্তব্য করেছেন। এমন কি, বইমেলার সময় ২ দিন বাড়িয়েও ক্রেতা তেমন পাওয়া যায়নি।
পরিসংখ্যান জানা যায়নি, অনুমান করা যায় এবারের মতো দর্শনার্থীর ভিড় বইমেলায় আর কখনো হয়নি। এর একটা কারণ, এবার প্রথম মেট্রোরেল চালু ছিল। ফলে ঢাকার উত্তরের মানুষ দলে দলে বইমেলায় আসতে পেরেছেন। প্রথম থেকেই লক্ষ্য করা গেছে, মেলায় দর্শনার্থীর তুলনায় বেচাবিক্রি খুব কম। অনেককেই বলতে শোনা গেছে, যে পরিমাণ দর্শনার্থী মেলায় আসে, তার ১০ শতাংশও যদি বই কিনতেন সব প্রকাশনীর বই খালি হয়ে যেত।
কথা হচ্ছে, যে পরিমাণ দর্শনার্থী বইমেলায় গেছেন, তত পরিমাণ বই বিক্রি হয়নি কেন? কেন প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এক মাসের বইমেলায় ১০০ কোটি টাকার বইও বিক্রি হয় না? অথচ, ২০২৪ সালে বাণিজ্য মেলায় বিক্রি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা, রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেছে ৩৯২ কোটি টাকা।
যারা বলেন, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য বই বিক্রি কম, তাদের কথা কতটুকু সত্য? এবার তো রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল না, জনজীবন স্বাভাবিক ছিল তারপরও বই বিক্রি এত কম কেন? বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, এ বছর বই প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০টি।
পৃথিবীজুড়েই বইয়ের পাঠক কমছে বটে; কিন্তু কিন্ডেল-পাঠক বাড়ছে। বাড়ছে অডিও-বইয়ের শ্রোতাসংখ্যাও; কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে পাঠকসংখ্যা বা বইপ্রেমীর সংখ্যা যে খুব বেশি বাড়ছে বলা যাবে না। বরং ঘুরেফিরে একশ্রেণির মানুষই বই পড়েন। প্রযুক্তি ও বিনোদনমাধ্যমের সহজলভ্যতা, প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা, জীবনযাপনে অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণেই মানুষ বইবিমুখ হচ্ছে; কিন্তু আত্ম-আবিষ্কারের জন্য, সমাজ-রাষ্ট্র সুন্দর করে গঠনের জন্য বই পাঠের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়টি রাষ্ট্র তথা আমরা যত বেশি অনুধাবন করব, তত বেশি মঙ্গল। তা না হলে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে ওপরে কখনো উঠবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে