জন্মনিবন্ধনের বাইরে ৩ কোটি নাগরিক
এতসংখ্যক নাগরিক রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে অদৃশ্য কেন
নাগরিকের জন্মনিবন্ধন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাংলাদেশ সরকার সে অনুযায়ী কাজ করে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছে; কিন্তু সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের ১৭ শতাংশেরও বেশি মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। সে হিসাবে ২ কোটি ৯২ লাখ মানুষ জন্মনিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। গত বুধবার (১২ জুন) এমন তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থ-সামাজিক জনমিতিক এক জরিপে।
আমাদের দেশে ২০০৪ সালের জন্মনিবন্ধন আইন অনুযায়ী জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-লিঙ্গ নির্বিশেষে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে সবাইকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আছে; কিন্তু নিয়মটি যথাযথভাবে পরিপালনে বিশৃঙ্খলা আছে খোদ সরকারি পর্যায়ে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
জন্মনিবন্ধন হলো একজন মানুষের জন্ম, বয়স, পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ। জন্মনিবন্ধন একজন নাগরিকের মানবাধিকার অর্জনে সহায়তা করে। বিশেষ করে সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তি, পাসপোর্ট ইস্যু, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমিজমা ক্রয়-বিক্রয়, মৃত্যু ও ওয়ারিশান সনদসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নাগরিকদের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রয়োজন। নবজাতকের জাতীয়তা নিশ্চিত করতে এটি আইনগত প্রথম ধাপ। তবে জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে ভোগান্তির কারণেই মূলত এত মানুষ নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে অভিযোগ আছে। পদে পদে নাগরিকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে নাগরিকদের বিরাট একটা অংশ রাষ্ট্র পরিচয়হীনতার সংকটে আছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জন্মসনদ দুটি গুরুত্বপূর্ণ নথি। এগুলো থাকা জরুরি। নাগরিক সেবা পেতে এসব নথির প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে বয়সভিত্তিক সময়সীমাটা গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় জন্মসনদের ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে অনেকেরই এই সনদটি নেই। তাদের প্রয়োজনও হয় না। জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের এটা থাকা আবশ্যক। যাদের নেই, তারা হয়তো দেশের বাইরে রয়েছেন। আর পাসপোর্টের ব্যবহার এখনো ব্যাপক হারে প্রয়োজন হচ্ছে না। সে কারণে টাকা ব্যয় করে অনেকে পাসপোর্ট করছেন না। আর এসব সেবা পেতে ভোগান্তির একটা বড় বিষয় তো রয়েছেই।
গবেষণা বলছে, দেশে পাঁচ বছরের নিচে আনুমানিক ১ কোটির বেশি শিশু আইনি বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও নিবন্ধনের বাইরে। তাহলে এতসংখ্যক শিশু রাষ্ট্রীয় আইনের দৃষ্টিতে অদৃশ্য। যেহেতু বিদ্যমান আইনে ৪৫ দিনের মধ্যে নবজাতকের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, ফলে স্বীকৃত পরিচয় ছাড়া এসব শিশু- শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আইনি সুবিধাসহ অন্যান্য মৌলিক সেবাপ্রাপ্তিতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে দেশে পাচার, বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম বেড়ে যাচ্ছে। তাই এসব সংকট ও সমস্যা সমাধানে সব শিশুর জন্মনিবন্ধন ও মৃত ব্যক্তির মৃত্যুসনদ নিশ্চিত করাটা বাঞ্ছনীয়।
আমরা চাই, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকদের সব দুর্ভোগ ও ভোগান্তির অবসান ঘটুক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নাগরিক তার সেবা পাক। সেক্ষেত্রে এই নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজীকরণ করা, দালালসহ সরকারি-বেসরকারি দুষ্কৃতদের বিচার করা ও শক্তিশালী অনলাইন সার্ভার স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে