Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের পর কেন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হামলা বাড়ছে

Rayhan Ahmed Tapader

রায়হান আহমেদ তপাদার

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

বিশ্বব্যাপী জাহাজে জলদস্যুদের হামলার পরিমাণ ২০২০ সালে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে পশ্চিম আফ্রিকাতেই রেকর্ডসংখ্যক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি একটি সমুদ্র পর্যবেক্ষক সংস্থা এ চিত্র তুলে ধরেছে। তারা এ সময় সমুদ্রে পাহারা বাড়ানোর আহ্বানও জানিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম ব্যুরো (আইএমবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর জলদস্যু হামলা ও সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ১৯৫টি। ২০১৯ সালে যে সংখ্যা ছিল ১৬২। এ ছাড়া গত বছর বিশ্বব্যাপী ১৩৫ জন নাবিককে বিশ্বব্যাপী অপহরণ করা হয়, এর মাঝে ১৩০টিই ছিল পশ্চিম আফ্রিকার গিনি উপসাগরে। লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নীল জলরাশির সমুদ্রতট ঘেঁষে অবস্থিত রাষ্ট্র সোমালিয়া।

সোমালিয়া নামটি শুনলে একসময় ক্ষুধায় কঙ্কালসার মানুষের ছবি উঠে আসত সংবাদমাধ্যমে। আর এখন হর্ন অব আফ্রিকার এ দেশের নামটুকু শোনামাত্র মানসপটে ভেসে ওঠে পণ্যপরিবাহী জাহাজ লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণ ইত্যাদি সব দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের ভয়ংকর চিত্রপট। সর্বশেষ ভারত মহাসাগরে এমভি আবদুল্লাহ নামে একটি বাংলাদেশি জাহাজ অপহরণের মধ্য দিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে এ জলদস্যুরা। জলদস্যুরা কীভাবে সাগরে জাহাজ অপহরণ করে, অপহরণের পর সে জাহাজকে কোথায় নিয়ে যায়, মুক্তিপণের অর্থই বা কীভাবে আদায় করে তারা আর এসবের পেছনে কারা জড়িত, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের যেন শেষ নেই। সম্প্রতি সোমালিয়ার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ২৩ বাংলাদেশি নাবিক ও তাদের পরিবারেরও ভাগ্য। ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার পাশ দিয়ে দিয়ে যাবার সময় বাংলাদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জলদস্যুতা অবশ্যই ঘৃণিত কাজ। আর যখন বাংলাদেশি নাবিকরা তাদের হাতে জিম্মি হন।

কিন্তু কেন সোমালিয়ার লোকেরা জলদস্যু হয়ে উঠল? আর কেনই বা সোমালিয়ায় এই জলদস্যুদের বিপুল জনপ্রিয়তা? কেনই বা তাদের বলা হয় সোমালিয়ার জলরক্ষী? সোমালিয়ার উপকূলের পানি ছিল আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান। কারণ, এই পানিতেই বিচরণ করে টুনা, মার্লিনসহ দামি মাছেরা। এই সম্পদই সোমালিয়ার কাল হলো। বিদেশি মাছ শিকারিদের নজর পড়ল সেখানে। তারা আধুনিক নৌযান ও গভীরে ফেলবার মতো জাল নিয়ে সোমালিয়ার সমুদ্রসীমার মাছ চুরি করতে থাকল। এতে বেকার হয়ে পড়তে থাকল সোমালিয়ার সামুদ্রিক জেলেরা। দ্বিতীয় বিপদটা আরও ভয়াবহ। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উচ্ছেদের পর সোমালিয়ায় গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘ নৈরাজ্যের মধ্যে রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিমারা সামরিক হস্তক্ষেপ চালায়। তাছাড়া সোমালিয়ার সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদের জন্যও সেখানে নিয়ন্ত্রণ চায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইতালি ও ফ্রান্স।

নব্বই দশক থেকে একের পর এক মার্কিন আক্রমণ, সিআইয়ের গোপন অভিযান, মার্কিন মদদে ইথিওপিয়ার আগ্রাসনে বিধ্বস্ত দেশটি আর তার দুর্ভিক্ষপীড়িত কোটি খানেক মানুষকে দোজখের সদর দরজা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ তাদেরও বলবার আছে অন্যরকম এক গল্প। আর সকল জাতির মতো সোমালিয়দেরও ইতিহাস আছে, আছে নাটকীয় উত্থান-পতন। তাদের একাংশ ছিল ইতালীয় শাসনে আরেকাংশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। তারা খুবই স্বাধীনচেতা জাতি। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা তাদের জনসংখ্যার তিনভাগকে মেরে ফেলে। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীও সেখানে গণহত্যা চালায়। সোমালিয়ার জলদস্যুদের সাথে অনেক জায়গাতেই মিল রয়েছে মধ্যযুগের ইউরোপীয় জলদস্যুদের। জলদস্যু বলতেই কাঁধে তোতা পাখি নিয়ে থাকা শয়তান মানুষের ধারণা আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে হলিউডি ছবিগুলো। আমরা যেমন ভাবি জলদস্যুরা কখনোই তেমনটি ছিল না।

জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ ছিল ১৬৫০ থেকে ১৭৩০ সাল। সেসময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুখপাত্ররা কুৎসা রটায় যে দস্যুরা হলো অমানুষ, বর্বর ডাকাত। সেই ধারণা আজো অনেকে বিশ্বাস করে; কিন্তু বারবারই আমজনতা তাদের ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেন? ভিলেইনস অব অল ন্যাশনস বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ মারকাস রেডাইকার এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানাতে পারেন। ধরুন আপনি সেসময়ের কোনো নাবিক বা সওদাগর, লন্ডনের ইস্ট অ্যান্ড বন্দর থেকে ক্ষুধার্ত ও তরুণ আপনাকে তুলে নেয়া হলো জাহাজে। যাত্রা শুরু করে একসময় দেখতে পেলেন এক কাঠের নরকে করে আপনি ভাসছেন। উদয়াস্ত খাটতে খাটতে আপনার পেশি কুঁচকে গেছে, আধাপেটা খাওয়া, এক মুহূর্তের জন্য কাজে উদাস হয়ে গেছেন। সর্বশক্তিমান সারেং আপনাকে চাবুক পেটা করবে। বারবারই যদি আপনার ফাঁকি ধরা পড়ে তো আপনাকে ছুড়ে ফেলা হবে সাগরে। অথবা মাস শেষে দেখলেন আপনার মজুরি মেরে দেয়া হয়েছে।

এই বর্বর দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী ওই জলদস্যুরা। তারা তাদের বর্বর ক্যাপ্টেনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সমুদ্রের কারবারের নতুন নিয়ম তৈরি করেছিল। জাহাজ হাতে পাওয়া মাত্র তারা তাদের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত করতো এবং সব সিদ্ধান্তই নিতো এজমালি ভাবে। লুটের মাল তারা এমনভাবে ভাগ করত, যা থেকে রেডাইকার বলছেন, ‘সেটা ছিল আঠারো শতকের সবচেয়ে সমতাবাদী ভাগজোখ’। এ জন্যই ডাকাত হওয়া সত্ত্বেও তারা ছিল জনপ্রিয়। যেমন সোমালিয়দের কাছে জনপ্রিয় তাদের জলদস্যুরা। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রশক্তিগুলো মওকা বুঝে সোমালিয়ার খাদ্য সরবরাহ কেড়ে নেয় এবং এর উপকূলে তেজষ্ক্রিয় বর্জ্র্য পদার্থ ফেলতে শুরু করে। সরকার গায়েব হয়ে যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই সোমালিয়ার উপকূলে হানা দিতে থাকে রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজ। তারা বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে সেখানে। উপকূলীয় অধিবাসীরা অসুস্থ হতে শুরু করে।

প্রথম প্রথম তাদের গায়ে অদ্ভুত দাগ দেখা দিত, তারপর শুরু হলো বমি এবং বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব। ২০০৫ সালের সুনামির পর, তাদের উপকূল ভরে যায় হাজার হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেলে। মানুষ তেজষ্ক্রিয়তায় ভুগতে থাকে। ৩০০ এরও বেশি মানুষ মারা যায়। সেসময়ে সোমালিয়ায় জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, ‘কেউ এখানে একটানা পারমাণবিক উপাদান ফেলছে। আরও ফেলছে সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি।’ খুঁজলে দেখবেন এর বেশিরভাগই আসছে ইউরোপীয় হাসপাতাল ও কারখানাগুলো থেকে। ইতালীয় মাফিয়াদের মাধ্যমে সস্তায় তারা এগুলো সোমালিয়ার জলসীমায় খালাস করে। ইউরোপীয় সরকারগুলো এ নিয়ে কিছু করছে? না, না তারা এগুলো পরিষ্কার করছে, না দিচ্ছে ক্ষতিপূরণ, না ঠেকাচ্ছে এগুলো ফেলা।

একই সময়ে অন্য কিছু ইউরোপীয় জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র লুট করে চলেছে। সোমালিয়ার প্রধান সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। ইউরোপ আগে অতিশোষণের মাধ্যমে নিজেদের মাছের ভাণ্ডার নিঃশেষ করেছে, এখন হামলে পড়েছে অন্যের পানিতে। সোমালিয়ার অরক্ষিত পানি থেকে তারা ফিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের টুনা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধরে নিয়ে আসে। স্থানীয় জেলেরা দেখতে পেল হঠাৎ, তাদের সর্বস্ব খোয়া গেছে এবং তাদের ক্ষুধার কোনো নিবারণ নেই। রয়টারের কাছে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক যুবক বলে, ‘যদি কিছুই করা না হয়, অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের সমুদ্র মাছহীন হয়ে পড়বে।’এই পটভূমিতেই ওই মানুষদের আবির্ভাব, যাদের আমরা বলছি ‘জলদস্যু’। সকলেই মানে যে, এরা আসলে সাধাসিধা জেলে। প্রথমে তারা স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র্য ফেলা ও মাছ ধরার জাহাজ ও ট্রলারগুলোকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।

একপর্যায়ে তাদের ওপর ট্যাক্স বসানোরও চেষ্টা চলে। এক টেলিফোন সংলাপে জলদস্যুদের এক নেতা সুগুল আলি বলেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বেআইনি মাছ ধরা এবং উপকূল দূষণ থামানো, আমরা জলদস্যু নই, ওরাই জলদস্যু, যারা আমাদের মাছ কেড়ে নেয়, যারা আমাদের সমুদ্র বিষ দিয়ে ভরে ফেলে এবং আমাদের পানিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। সোমালীয় জলদস্যুদের মধ্যে বেশ কিছু খারাপ লোকও আছে। তারা জাতিসংঘের খাদ্য সরবরাহও লুট করে। এবং এও সত্য যে, স্থানীয়দের কাছে এই জলদস্যুরা বিপুলভাবে জনপ্রিয়। স্বাধীন সোমালীয় সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, ৭০ ভাগ সোমালীয় মনে করে জল দস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার জাতীয় কৌশল।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়, জর্জ ওয়াশিংটনসহ মার্কিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা জলদস্যুদের দিয়ে মার্কিন সমুদ্রসীমা রক্ষার কাজ করিয়ে নিতেন। এ জন্য তাদের টাকাও দেয়া হতো, কারণ সেসময় আমেরিকার কোনো নৌবাহিনী ছিল না। বেশিরভাগ মার্কিনির কাছেও এটাকে ঠিকই মনে হয়েছিল। সোমালীয়রা কি তাদের থেকে খুবই আলাদা? যদি সত্যিই জলদস্যুতা বন্ধ করতে হয়, তাহলে এর গোড়ায় হাত দিতে হবে। থামাতে হবে পশ্চিমাদের করা অপরাধগুলো। কয়েক বছর আগে পশ্চিমা এক সংবাদ মাধ্যমের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে প্রায় ৩০টির মতো ঘটনায় নাবিকদের মুক্তিপণের বিনিময়ে উদ্ধার করা হয়েছে। সেইসঙ্গে অপহৃত জাহাজকে মালিকপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তিপণের পদ্ধতি বেশ অভিনব। একটি বিশেষ ব্যবস্থায় বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ পানিতে ফেলা হতো। পানিতে ফেলা সেই অর্থ সংগ্রহ করে জাহাজে গিয়ে গুনে নিশ্চিত হওয়ার পর সেখান থেকে চলে যেত জলদুস্যরা।

একই সময়ে অপহৃত জাহাজের কর্তৃপক্ষের লোকজন সেই জাহাজে ঢুকে তাদের নাবিক ও পণ্য বুঝে পেয়ে সেখান থেকে নিকটতম নিরাপদ বন্দরে চলে যেত। পুরো প্রক্রিয়াটিই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অর্থ পেয়েও জাহাজ ও নাবিকদের যদি জলদস্যুরা ছেড়ে না দেয়, তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতো। তবে এ ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। জলদস্যুরা দাবি করা অর্থ পাওয়ার পর তাদের কথা রেখেছে। ২০০৯ সালে দুনিয়ার তাবড় সরকারগুলো একযোগে সোমালীয় জলদস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেসময় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ দুই ডজনেরও বেশি দেশের যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সোমালিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে। সেসময় থেকে ওই এলাকায় আন্তর্জাতিক প্রহরা বজায় ছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ শুরুর পর। ইসরায়েলি গণহত্যার জবাবে ইয়েমেনের ইরানপন্থী মিলিশিয়া হুতিরা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা দিতে থাকে। তাদের ঠেকাতে কাছাকাছি থাকা আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী সোমালিয়ার সমুদ্রসীমা থেকে নিয়ে আসা হয় লোহিত সাগরে। এই সুযোগ নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এভাবেই বাংলাদেশি জাহাজ ও তার ২৩ নাবিক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এটাই পরিবার ও স্বজনদের প্রত্যাশা।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ