ধান ফলানো হাতই কেন অবহেলিত?
উৎপাদিত ধান বাজারে তোলার পর প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ছেন কৃষকেরা। অনেক ক্ষেত্রে খরচের টাকা তুলতেও হিমশিম খেতে হয়। অথচ দিন দিন চালের দাম বেড়ে চললেও, এখনো কৃষকের শূন্য হাত শূন্যই রয়ে গেছে।
কৃষকরা বলছেন, ধান চাষ করে তারা যে খুব লাভবান হচ্ছেন- তা কিন্তু নয়। অনেক সময় কোনমতে শুধু উৎপাদন খরচই উঠে আসে। আর লোকসান তো আছেই। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় ধান উৎপাদন করতে পারবেন না তারা। ইতোমধ্যে অনেকেই ধান চাষ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়ার অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. নাজমুল হক বলেন, 'এবার এ জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও ভালো নেই কৃষক।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান বাজার অনুযায়ী এক বিঘা জমিতে হালচাষ থেকে শুরু ধান কাটা-মাড়াই পর্যন্ত প্রায় ১৩-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে সার, পানি, ওষুধ খরচসহ কৃষিশ্রমিকের মজুরি রয়েছে। এক বিঘা জমি থেকে ১৫-২৩ মণ পর্যন্ত ধান পাওয়া যায়। বর্তমানে জাত অনুযায়ী বাজারে ধানের মণ ১১০০-১২৫০ টাকা। অনেক সময় ধানের মণ হাজার টাকার নিচেও নেমে আসে।
উৎপাদিত ধানের বাজার মূল্যের ওপর গড় হিসাবে দেখা যায়, ভালো ফলন ও দাম পেলে বিঘা প্রতি ৫-৭ হাজার টাকা আয় হয়। ধান বিক্রির এই টাকায় কৃষকের শ্রমের মজুরিও ওঠে না।
ধান বপোন থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত তিন-চার মাস সময় লাগে।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার মনিরুজ্জামান মনির জানান, নিজেরসহ অন্যের জমি বর্গা নিয়ে প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে এবার ধানের চাষ করেছেন। আশানুরূপ ধানের দাম পাওয়া অনেক কঠিন। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফলন কমে যায়। এতেও লোকসানে পড়তে হয়।
বগুড়ার শাজানপুর উপজেলার কৃষক মারুফ হোসেন জানান, ধান চাষে শ্রম-ঘামের মজুরি তোলাটাই কঠিন। এবারই তিনি শেষবারের মত ধান চাষ করেছেন। সামনে মৌসুম থেকে নিজে আর ধান চাষ করবেন না। জমি বর্গা দেবেন।
চালের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইরি ধান থেকে উৎপাদিত চালের কেজি প্রকারভেদ অনুযায়ী ৪৬-৭০ টাকা পর্যন্ত।
ধান ও চালের গড় দাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত চালের মূল্য ৪০ হাজারেও বেশি হয়। এতে স্পষ্ট হয় যে, কৃষকের চাইতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরাই লাভবান হচ্ছেন। অথচ কৃষকের তুলনায় তাদের শ্রমের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে।
কৃষকদের অভিযোগ, চালের দাম প্রতি বছরই বাড়ছে। অন্যদিকে তারা অবহেলিতই থাকছেন। ফলে কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকেরাই আছেন বিপাকে। কোনোমতে খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন তারা। প্রত্যাশা অনুযায়ী লাভের মুখ দেখাটা যেন তাদের কাছে স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম সোহাগ। এবার তিনি ৩২ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছেন।
সোহাগ জানান, ধানের ভালো ফলন ও দাম পেলে কিছু লাভ হয়। যদিও শ্রমের তুলনায় তা সামান্য। অনেক সময় তো খরচের টাকা উঠবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কা থাকে।
সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট এর বগুড়ার সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে সরকারিভাবে লটারির মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে। এরমধ্যেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ ধান বিক্রি করছেন। বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকেরা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের কৃষকরা কখনই লাভবান হবেন না।
তিনি আরও জানান, সরাসরি কৃষকের হাত থেকে ধান কিনতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে ধান ক্রয়কেন্দ্র করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে