আন্তর্জাতিক কনভেনশন গণহত্যা বিষয়ে নিশ্চুপ কেন?
মানুষে মানুষে সংঘাতের ক্ষেত্রে নিয়ম নির্ধারণের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; কিন্তু আধুনিক যুগের আগে, বিশ্বের কোনো শক্তিরই সব দেশের ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল না কিংবা মিত্র দেশগুলোর জোট ছিল না-যাদের ওপর এই কাঙ্ক্ষিত নিয়মগুলো প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করা যাবে। তবে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের মধ্য কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন পালন করা বাধ্যতামূলক করা হয়। ইউরোপীয় দেশগুলো মূলত এই সিদ্ধান্তে আসে যে, ওই চুক্তিগুলো আমলে নিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক আইন পালনে বাধ্যবাধকতা আরোপের ক্ষমতা রয়েছে। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, ইউরোপের এই দেশগুলো সামুদ্রিক নিয়মনীতির বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়, যা ছিল যুদ্ধের আইনের প্রথম ভিত্তি। এই আইনগুলো বিংশ শতকে ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে এবং এর মধ্যে কিছু আইন আজ অবধি বলবৎ রয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরে, মানবিক বিপর্যয় এবং গণহত্যা নির্মূলের ক্ষেত্রে এই আইনের মানবতার দিকগুলো আরও বেশি নজর কাড়ে।
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ বিশ্বের প্রথম কোনও যুদ্ধ নয় যেখানে উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। কমবেশি যতবারই বড় কোনো সামরিক সংঘাত হয়েছে,ততবার যুদ্ধরত পক্ষগুলো যুদ্ধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে এবং এ নিয়ে প্রচার চালিয়েছে। সামরিক সংঘাতের সময় যে অভিযোগগুলো বার বার সামনে আসে সেগুলো হলো: বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, শিশুহত্যা, অপ্রচলিত এবং নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার, এমনকি গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের মতো বড় অভিযোগগুলো সবচেয়ে বেশি সামনে আসে। সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এবং হামাস দুটি পক্ষই এক ধরনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।
ইসরায়েল যেহেতু জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র, তাই তাদের কিছু আইনি দায়িত্ব রয়েছে, যেটা কি না হামাসের নেই। তবে সমালোচকরা বলছেন, ইসরায়েল তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন করে না। বরং উভয় পক্ষই জোর দিয়ে বলে যে, তারা যা করেছে সেটা আন্তর্জাতিক আইন এবং যুদ্ধের আইনি কাঠামোর মধ্যেই ছিল। এভাবে তারা তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে চায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগুলোর মধ্যে একটি হল যুদ্ধের আইনে উল্লিখিত ‘আত্মরক্ষা’ নীতি। উভয় পক্ষই এই আত্মরক্ষার বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। যদিও জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের রাস্তায় পুড়ে যাওয়া ফিলিস্তিনি মানুষ, পোড়া তাঁবু, লাশের স্তূপ। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে ধুলায় দিশেহারা জীবিত ব্যক্তিরা তাদের ছোট বাচ্চাদের প্রাণহীন লাশ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।
পশ্চিমা কোনো সংবাদমাধ্যমে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন? গাজা বা লেবাননে ইসরায়েল সংঘটিত যুদ্ধসন্ত্রাসের ছবি পুলিৎজার পুরস্কারের মনোনয়ন পায় না, পাবেও না। কারণ, সম্পাদকেরা ভয় পান। গিওরা এইল্যান্ডের তৈরি করা পরিকল্পনাই গ্রহণ করেছে ইসরায়েল। কে এই এইল্যান্ড? তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক প্রধান। অবসর নেয়ার পর জাতীয় নিরাপত্তা অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছিলেন। এইল্যান্ডের পরিকল্পনার মূল কথা আলোচনা সমাধান নয়। উত্তর গাজার ৪ লাখ বাসিন্দাকে দুটি বিকল্প দিতে হবে-হয় অনাহারে মরো অথবা জায়গা ছেড়ে পালাও। এটাই ইসরায়েলের যুদ্ধে লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র উপায়। এই পরিকল্পনা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, সংসদ এবং সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি এইল্যান্ডের পরিকল্পনা গভীরভাবে অধ্যয়ন করছেন। নিজের প্রধান সহকারী রন ডারমারকে গত ডিসেম্বরে বলেছেন ‘গাজা সাফ’ করার উপায় খুঁজে বের করতে। সে অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে।
তাই গাজার মধ্য দিয়ে একটা করিডর তৈরি করেছে ইসরায়েল। সেখানে সৈন্যদের বিপুলসংখ্যায় মোতায়েন করা হয়েছে। এর ফলে এখন গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গেল ফিলিস্তিনিদের। এরই মধ্যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডও চলছে। অবিরাম গোলাগুলি, তাঁবুতে দুই হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলা তো চলছেই। সঙ্গে হাজির হয়েছে ইসরায়েলিদের সর্বশেষতম কিলিং মেশিন বিস্ফোরণকারী রোবট। এই রোবট একসঙ্গে পরপর ছয়টি বাড়ি ধ্বংস করতে সক্ষম। তারপরও জাবালিয়ার লোকেরা তাঁদের বাড়ি থেকে সরে আসছেন না। তাঁরা বলছেন, দক্ষিণে মারা যাওয়ার চেয়ে গাজা শহরে থেকে মরা ভালো। মৃত্যু তো মৃত্যুই; কিন্তু দক্ষিণে তাঁবুতে বাস করা জীবন অসহনীয়। উত্তরের তুলনায় অনেক কঠিন। প্রতিদিন চলছে হত্যাকাণ্ড। পুরো পৃথিবী যেন নীরব থেকে একে উৎসাহিত করছে। বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আভি বেরেলি গত অক্টোবরে লিখেছেন যে ফিলিস্তিনিরা এমন একটি সমাজ, যারা মৃত্যুকে উপাসনা করে।
গণহত্যায় সমর্থনকারী এই অধ্যাপকেরা, নিরস্ত্র মানুষ-নারী-শিশুদের হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধী সমস্ত জেনারেল এবং সৈন্যরা নিরাপদেই থাকেন। এবারও তারা ক্রিসমাসের কেনাকাটার জন্য লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যাবেন, ওয়েস্টঅ্যান্ডে কেনাকাটা করবেন। তাদের কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকবে না। আন্তর্জাতিক আদালতগুলো তাদের কিছু করতে অক্ষম। একইভাবে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সম্পাদক জেরেমি বোয়েন সাক্ষাৎকার নেন এইল্যান্ডের। তার ভাবভঙ্গি এমন, যেন কোনো গবেষকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। যেন এইল্যান্ডের মানুষ মারার পরিকল্পনা এক বৈধ জিনিস। সম্ভবত বোয়েন মনে করেন যে জেনেভা ও গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলো মৃত জিনিস। এইল্যান্ড নিজে যা বলেন, একজন রিপোর্টার হিসেবে বোয়েন তাকে চ্যালেঞ্জ করেননি বা তার দাবি যাচাই করার চেষ্টা করেননি। বিবিসি ও স্কাই নিউজের মতো সংবাদমাধ্যম থাকে নীরব।
শিশু, নারী, বেসামরিক মানুষ হত্যাকারী সশস্ত্র যোদ্ধা এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্যকে তারা অস্পষ্ট করে দেয়। ইসরায়েলের উদ্দেশ্যও তা-ই। নীরবতা সময়ক্ষেপণ করে। আর এই সময় বাড়ায় মৃত্যু। উত্তর গাজার জন্য ইসরায়েলের পরিকল্পনা সফল হলে দক্ষিণ লেবানন হবে পরবর্তী শিকার। ইসরায়েলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেইর বেন শাব্বাত বলেছেন, লেবাননে ইসরায়েলের বর্তমান অভিযানের তিনটি বিকল্প ছিল ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা, একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, যা সীমান্তে ইসরায়েলের পছন্দের শাসক বসাতে দেবে আর পুরো সীমান্ত বরাবর জমি খালি করা। শাব্বাত নিজে শেষ বিকল্পের পক্ষে। তাঁর মতে,এই বিকল্পের সুবিধা হলো এতে তুলনামূলক ভাবে খরচ কম। আর এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে ভিটেমাটিছাড়া হতে হবে। ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো জায়গা আক্রমণ করলে ইসরায়েল খোদ নিজে এসে হাজির হবে প্রতিশোধ নিতে। সর্বোপরি, ধর্মীয় জায়নবাদীরা তো দাবি করেনই যে তাদের জেরুজালেম বিস্তৃত দামেস্ক পর্যন্ত।
এই পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? আরব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের একটি স্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। আজ যারা যুদ্ধ দেখছেন পাশে দাঁড়িয়ে, কাল তারাও বাধ্য হবেন যুদ্ধে নামতে। ইসরায়েল তার সীমানা বাড়িয়েই যাচ্ছে। এই হুমকি সেখানকার প্রতিটি দেশকে জড়িয়ে ফেলবে। জর্ডান একসময় ইসরায়েলের সঙ্গে তার শান্তি চুক্তি ছিন্ন করবে। ইরান ও হিজবুল্লাহ লড়বে জীবনের জন্য। ২০০১ সালে তালেবানের পতন ঘটাতে আমেরিকানদের কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। আর আমেরিকানদের তাড়াতে তালেবানের লেগেছিল ২০ বছর। ২০০৩ সালের এপ্রিলে বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি নামাতে আমেরিকানদের লেগেছিল তিন সপ্তাহ। ইরাকে আমেরিকানদের যুদ্ধ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হতে লেগেছিল আরও আট বছর সময়। আর যে যুদ্ধের কথা আমরা বলছি, তা কোনো শাসক হটানোর যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধে সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক ও ইরানের সুন্নি ও শিয়াদের আত্মপরিচয় জড়িয়ে যাবে। এই যুদ্ধ হবে তাদের প্রত্যেকের জন্য নিজের অস্তিত্বের লড়াই।
যুদ্ধের আইন সম্পর্কিত যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জেনেভা কনভেনশন যা ১৯৪৮ সালে জেনেভায় অনুমোদিত হয়েছিল। এই চুক্তিটি ১৯৪৮ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত চারটি ভিন্ন কনভেনশনে অনুমোদন পায়। প্রতিটি কনভেনশনে যুদ্ধের সময় লড়াইরত দেশগুলোর আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জেনেভা কনভেনশন নামে পরিচিত এই আইনগুলোর সেট সাম্প্রতিক দশকে সংশোধন করা হয়েছে। প্রথম কনভেনশনে, যুদ্ধে আহতদের কীভাবে চিকিৎসা করা যায় সে সম্পর্কিত নিয়মগুলো ইতিহাসে চতুর্থবারের মতো আপডেট করা হয়েছে। সেইসাথে ১৮৬৪ এবং ১৯২৯ সালের বাকি নিয়মগুলোও আপডেট করা হয়েছে। দ্বিতীয় কনভেনশনে নৌ-যুদ্ধে যুদ্ধাহত-সংক্রান্ত নিয়মাবলি এবং যুদ্ধজাহাজকে কীভাবে সহায়তা প্রদান করা যায় তা চুক্তি আকারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৃতীয় কনভেনশনে, যুদ্ধবন্দীদের ইস্যুটি পর্যালোচনা করা হয়েছিল এবং তাদের সাথে কী ধরণের আচরণ করা হবে এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক আইনে যুক্ত করা হয়।এবং চতুর্থ কনভেনশনে, যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা হয়। সেখানে যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যুদ্ধের আইন প্রণয়ন করা হয়। এমন নানা সমালোচনা নির্বিশেষে, অনেক ক্ষেত্রেই যুদ্ধের আইন প্রয়োগ হয়েছে।
যুদ্ধের আইনের অংশ হতে পারে এমন অনেক চুক্তি গৃহীত হয়েছে। বৈরিতার সমাধান আনতে দায়ী রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং জরিমানা আরোপ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক আদালত বসিয়ে বিচার করা হয়। বর্তমানে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ছাড়াও যা এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশের আনা নানা অভিযোগ নিয়ে কাজ করে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই দুটি আদালতেরই যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যার মতো বিভিন্ন অভিযোগ মোকাবেলা করার ক্ষমতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ থেকে, নির্বাহী গ্যারান্টি শুধু যুদ্ধের আইনের ক্ষেত্রে নয়, বরং প্রায় সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে