জাতীয় খেলা কাবাডিতে কেন আমরা ‘ব্যাকবেঞ্চার’?
ম্যানচেস্টার সিটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পর সাংবাদিকরা ক্লাবটির কোচ পেপ গার্দিওলাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার দলের এ সাফল্যর রহস্য কী? ইংলিশ ক্লাবটির স্প্যানিশ কোচের ভাবলেশহীন উত্তর ছিল, ‘কোনো রহস্য নেই। বিষয়টি খুবই সাধারণ যে, ক্লাবের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মাঠকর্মী পর্যন্ত সবাই একই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছি।’ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে দৃষ্টি রাখলে ঠিক উল্টো চিত্র খুঁজে পাবেন!
কর্মকর্তারা ব্যস্ত দলাদলিতে- একেকটা নির্বাহী কমিটি যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সভাপতি একদিকে তো সাধারণ সম্পাদক উল্টো দিকে। অন্যান্য কর্মকর্তারাও একেক দলে বিভক্ত! অনেক ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল অফিসিয়ালদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বর অভিযোগ উঠছে। সাফল্যর শর্টকাট খুঁজতে গিয়ে ডিপ ফ্রিজে তুলে রাখা হচ্ছে প্রকৃত উন্নয়ন কার্যক্রম। টেবিল গেমে সাফল্য এনে ক্রীড়া প্রশাসন থেকে বাহবা নেয়ার প্রবণতাও হরহামেশা দেখা যায়। সবকিছুর যোগফলে ক্রীড়াঙ্গনের ট্রেন যেন লাইনচ্যুত। লাইনচ্যুত ট্রেনকে দূরের গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যর্থ চেষ্টাই করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। গোটা ক্রীড়াঙ্গনের রুগণ চেহারা ছাপ স্পষ্ট দেশের কাবাডিতেও। যে কারণে জাতীয় খেলায় আমরা ‘ব্যাক-বেঞ্চার’।
সাফল্যর চেনা পথ হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ কাবাডি। একসময় এশিয়ান গেমস থেকে নিয়মিত পদক এনে দিয়েছে খেলাটি। ২০০৬ সালের দোহা গেমসের পর থেকে পুরুষ দল পদকশূন্য। ১৯৯০ সালের বেইজিং গেমসে কাবাডি যুক্ত হয়। অভিষেক আসরের পর ১৯৯৪ সালের হিরোশিমা গেমসেও রুপা জয় করে বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালের ব্যাংকক গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জয় করা বাংলাদেশ ২০০২ সালের বুসান গেমসে রুপা পুনরুদ্ধার করে। ২০০৬ সালে দোহা গেমসে ব্রোঞ্জ জয়ের পর থেকে সাফল্যের চেনা পথটা হারিয়ে ফেলেছে পুরুষ দল- ২০১০ সালের গুয়াংজু গেমস (পঞ্চম), ২০১৪ সালের ইনচন গেমস (সপ্তম), ২০১৮ সালের জাকার্তা গেমস (পঞ্চম) এবং ২০২২ সালের হাংজু গেমস (পঞ্চম) থেকে শূন্যহাতে ফিরতে হয়েছে।
২০১০ সালের গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে যুক্ত হয় নারী কাবাডি। অভিষেক আসরে বাংলাদেশ ব্রোঞ্জ জিতেছে। ব্রোঞ্জ ধরে রাখে ২০১৪ সালের ইনচন গেমসেও। নারী দলের পরের গল্পটা পুরুষ দলের মতোই- সাফল্যর চেনা পথ হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের জাকার্তা গেমসে সপ্তম হওয়া বাংলাদেশ ২০২২ সালের হাংজু গেমস শেষ করে ষষ্ঠ স্থান নিয়ে। পুরুষ ও নারী বিভাগে লাল-সবুজরা হারিয়ে ফেলা পথটা আদৌ খুঁজে পারে কি না- এখনো বলা কঠিন। ঘরোয়া কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতার কারণে আপাতত আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি যে, ২০২১, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে টানা চারটি বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক কাবাডি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ। চার আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্বাগতিকরা। আমন্ত্রণমূলক এ আয়োজনকে সাফল্য হিসেবে দেখা হলেও এ নিয়ে নানা প্রশ্নও ছিল, প্রশ্ন এখনো আছে, যার অন্যতম বিশ্ব কাবাডির পরাশক্তি দলগুলোকে আমন্ত্রণ না জানানো। কিছু ক্ষেত্রে স্বাগতিক হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেয়ার অভিযোগও আছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। যদিও কাবাডি ফেডারেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন।
জুনিয়র ওয়ার্ল্ড কাপে ব্রোঞ্জ পদক জয়ের মাধ্যমে মাঝে তৈরি হয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা। ২০১৯ সালে ইরানের কিশ দ্বীপে আয়োজিত আসরের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি ২০২৩ সালের পরবর্তী আয়োজনে। সে আসর থেকে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। ওই আসরে বাংলাদেশকে টপকে ব্রোঞ্জ জিতেছে নেপাল! ২০২৫ সালের পরের আসর ঘিরে এখনো পরিকল্পনা শুরু হয়নি। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ করার কারণে জাতীয় খেলায় নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। কুফল হিসেবে সদ্যসমাপ্ত বিচ কাবাডি ওয়ার্ল্ড কাপে দল পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।
অতীতে বাংলাদেশ কাবাডির প্রধান সমস্যা ছিল অর্থ। অতীতে দায়িত্ব পালন করা কমিটির প্রচেষ্টায় আর্থিক সমস্যা কেটে গেছে। কোনো ক্রীড়া ডিসিপ্লিন যে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় পণ্য হয়ে উঠতে পারে- তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন, যার মাধ্যমে আর্থিক কাঠামো মজবুত হয়েছে বটে। পরিকল্পনার অভাব এবং কর্মকর্তাদের মাঝে সমন্বয়হীনতার কারণে অর্থ থাকার পরও ব্যর্থতা ঝেড়ে এগিয়ে যেতে পারেনি কাবাডি। অথচ এ সময়ের মধ্যে আইজিপি কাপ জাতীয় যুব কাবাডির মতো ঘরোয়া আসর এবং আন্তর্জাতিক একাধিক আসরের আয়োজন ছিল বিশ্বমানের।
জাতীয় খেলা কাবাডিকে এগিয়ে নিতে নিকট অতীতের মতো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা ধরে রাখার পাশাপাশি ঘরোয়া সব ধরনের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা জরুরি বলে মনে করছেন বোদ্ধারা। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, খেলোয়াড়, কোচ, টেকনিক্যাল অফিসিয়াল, ফেডারেশন কর্মকর্তা এবং তৃণমূল সংগঠকদের এক সুতায় গাঁথা। সংশ্লিষ্টদের মাঝে পারস্পরিক দূরত্ব কমাতে পারলে উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে- এমনটাই মনে করছেন খেলাটির ঘনিষ্ঠরা।
বিশ্ব কাবাডির পরাশক্তি ভারত এবং ইরান। বৈশ্বিক পরিসরে পাকিস্তানও এ খেলায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। আধুনিক ধ্যান-ধারণা এবং খেলাটি সংশ্লিষ্টদের উন্নত সুযোগ-সুবিধার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অন্য দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। উল্লিখিত দুটি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারায় পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভারতের পাতিয়ালা থেকে কোচেস কোর্স করা আব্দুল হক বয়সের কারণে এখন কোচিংয়ে নেই। সাবেক দুই খেলোয়াড় সুবিমল চন্দ্র দাস ও আব্দুল জলিল কোচ হিসেবে এখনো নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। পাতিয়ালা থেকে কাবাডি কোচিংয়ে ডিপ্লোমা আছে হামিদুর রহমান ও আব্দুল হাকিমের। স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে শর্ট-কোর্স করে এসেছেন খান মো. ইমতিয়াজ (জীবন) ও জায়েদ হোসেন, প্রসেনজিৎ বিশ্বাস, মোহাম্মদ সাগর, রবিউল ইসলাম রবি। আধুনিক কাবাডি জ্ঞানসম্পন্ন কোচের সংখ্যাটা নগণ্য।
এ জায়গায় ইরান, ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। আধুনিক ধ্যান-ধারণা সমৃদ্ধ প্রচুর কোচ রয়েছে দেশগুলোতে। খেলাটি উন্নয়নে দেশগুলোতে নেয়া হচ্ছে ক্রীড়া বিজ্ঞানের সহায়তা। বাংলাদেশ যা থেকে যোজন যোজন দূরে! নৈপুণ্য উন্নতি করতে হলে একজন খেলোয়াড়কে কোন প্রক্রিয়ায় অনুশীলন করতে হবে, সে অনুশীলনের পর তার খাবার-দাবার কেমন হবে- দুই বিষয়ে এখনো সমন্বয় নেই। ইনজুরিগ্রস্ত অবস্থায় ফেডারেশন থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার বিষয় এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। ফেডারেশনের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মাঝেও গ্রুপিং-লবিং বিদ্যমান। সবকিছুর যোগফলে জাতীয় খেলায় ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রচণ্ড অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের কাবাডিকে বাঁচাতে হলে এ অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার বিকল্প নেই।
ওপরের বিষয়গুলো থেকে জাতীয় পর্যায়ের কাবাডি সম্পর্কে খানিক ধারণা পাওয়া গেছে। তৃণমূল পর্যায়ে দৃষ্টি রাখলে অবশ্য আরও করুণ চিত্র দেখা যাবে। গ্রাম-গঞ্জে ঐতিহ্যবাহী এ খেলার চর্চা এখন নেই বললেই চলে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে তৃনমূল পর্যায়ে কিছু কার্যক্রম হয়ে থাকে। সে কার্যক্রমে আবার গা ছাড়া ভাব লক্ষণীয়। রুগণ এ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যারা জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসছেন, তদের পরিচর্যা করে জাতীয় দলের উপযোগী করতে ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন সার্ভিসেস দল; কিন্তু তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় দল পর্যন্ত সমন্বিত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না বলেই বাংলাদেশ কাবাডিতে ছন্নছাড়া অবস্থা বিদ্যমান- এমনটিই মনে করছেন খেলাটি বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিভা হারিয়ে যাওয়ার করুণ চিত্র চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে ২০২১ সালের আইজিপি কাপ। সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টকারী এ আসর দিয়ে ছেলে ও নারী বিভাগে একঝাঁক তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে এসেছিল। যাদের হাত ধরে বদলে যেতে পারত দেশের কাবাডির চেহারা; কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা এবং সমন্বিত পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে গেছে আইজিপি কাপ জাতীয় যুব কাবাডি প্রতিযোগিতা দিয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়রা।
জাতীয় খেলায় পিছিয়ে যাওয়ার গল্প আর হতাশার চিত্র ভেদ করে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনার সোনালি রোদ! তেমনই এক সম্ভাবনার নাম মিজানুর রহমান। প্রতিভাবান এ রেইডার সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু কাপে আলো ছড়িয়েছেন। ভারতের প্রো-কাবাডির দল দাবাং দিল্লি কাবাডি ক্লাব কুশলী এ রেইডারকে দলভুক্ত করেছে। অতীতে আরদুজ্জামান মুন্সি, তুহিন তরফদার, জিয়াউর রহমান (জুনিয়র), লিটন আলী, মাসুদ করিম, আরিফ রাব্বানি, সাজিদ হোসেনরাও প্রো-কাবাডিতে খেলে এসেছেন। একেক সময় আসা এমন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের এক সুতায় গাঁথার কার্যকর উদ্যোগ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না দেশে।
আন্তর্জাতিক কাবাডি সংস্থার স্থায়ী সদস্য দেশ সংখ্যা ২৪, প্রাথমিক সদস্যসংখ্যা ১২। নৈপুণ্যর বিচারে বাংলাদেশ বিশ্ব কাবাডিতে ৫-৬ নম্বরে অবস্থান করছে। যার অর্থ বিশ্ব কাবাডির শীর্ষস্থান থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি দূরে নেই। ওই অবস্থান থেকে শীর্ষ তিনে উঠে আসা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। সেখানে উঠে আসতে পারলে এশিয়ান গেমস এবং ওয়ার্ল্ড কাপের মতো আসরে পদক নিশ্চিত হবে। পদক নিশ্চিত করার পর আরও উন্নতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে