Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

এই তরুণরা কেন বড় হতে পারেন না?

Dulal Mahmud

দুলাল মাহমুদ

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

সিসি অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে আবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। আপাতদৃষ্টিতে এটা হয়তো বড় সাফল্য নয়। তবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে টপকে পর পর দুবার শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোকে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। আটবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করা অবশ্যই কৃতিত্বের পরিচায়ক; কিন্তু বাংলাদেশ যেখানে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে, সেখানে জুনিয়র এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে না-ও হতে পারে।

২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৬ দেশের প্রতিযোগিতায় তরুণরা বিশ্ব জয় করে আমাদের প্রত্যাশাকে রাঙিয়ে দেয়। অবশ্য পরের দুই আসরে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ৮ দেশের এশিয়ান পর্যায়ে উপর্যুপরি দুবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া কতটা তাৎপর্যময়? ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য হিসেবে ২০১০ সালে এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জয়কে ধরা যেতে পারে।

সেবার এশিয়ান গেমসে প্রথমবার ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হলেও তাতে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই দুর্বল। দায়সারাভাবে আয়োজিত সেই গেমসে প্রতিপক্ষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দল নিয়ে বাজিমাত করে বাংলাদেশ। টাইগাররা ইতিহাস গড়লেও মনের মধ্যে একটা খচখচানি রয়ে গেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গৌরব করার মতো সাফল্য বাংলাদেশের নেই।

ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয় আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ, আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, আইসিসি মেন্স টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে। এই টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি বাংলাদেশ। তরুণরা যেভাবে হোক, এশিয়া এবং বিশ্ব পরিসরে সেরা হয়েছে। বড়রা কেন সেটা পারছেন না?

একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, এই তরুণরা বড় হয়ে সেই সাফল্যের ধারা কেন অব্যাহত রাখতে পারছেন না? না কি ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত অর্থে বড় হয়ে ওঠার পরিপক্বতায় খামতি রয়ে যাচ্ছে? না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কী কারণ? এই অপারগতা বা ব্যর্থতার সুলুকসন্ধান কি করা হয়েছে?

ক্রিকেট প্রচলিত অন্যান্য খেলার মতো নয়। গতিময়তা যে কোনো খেলার মূল বৈশিষ্ট্য হলেও ক্রিকেট তার ব্যতিক্রম। এর পরিচিতি ‘জেন্টেলম্যানস গেম’ হিসেবে। এ কারণে ক্রিকেটকে মূলধারার খেলা মনে করা হয় না। আর গতির খেলায় বিশ্বমানের খেলোয়াড় এবং দলে পরিণত হতে হলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যাবশ্যকীয়, তা থেকে আমরা ঢের পিছিয়ে আছি।

শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সক্ষমতা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতি, ভুগোল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা প্রভৃতি আমাদের অনুকূলে নয়। এমনকি আজতক বড় মাপের সহজাত প্রতিভারও দেখা মেলেনি। সে কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের কোনো অবস্থানই নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য গভীর ও বিস্তৃত গবেষণা হয়নি।

সর্বোপরি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ যথাযথভাবে নির্ণয় করা যায়নি। ব্যর্থতার কারণ জানতে পারলে তা থেকে বের হয়ে আসার অন্তত উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা কবে সম্ভব হবে?

মূলধারার খেলায় ক্রমাগত ব্যর্থতায় আমাদের আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত খেলাগুলোর সঙ্গে ক্রিকেট খেলাকে মেলানো যাবে না৷ অবশ্য ক্রিকেট খেলায়ও আছে দক্ষতা, কৌশল ও অ্যাথলেটিসিজমের সমন্বয়; কিন্তু অন্য খেলায় চোখের পলকে সিদ্ধান্ত নিতে হলেও ক্রিকেট খেলা যায় ভেবেচিন্তে আর খানিকটা সময় নিয়ে। খুব বেশি তাড়াহুড়ো নেই। রয়ে-সয়ে খেলা যায়।

ক্রিকেটেও কখনো-সখনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হলেও তার সঙ্গে অন্য খেলাগুলোর গুণগত পার্থক্য রয়েছে। ক্রিকেটে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পার্থক্য সহজেই নিরসন করা যায়। শক্তিহীন দল হয়েও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা যায়।

সবচেয়ে সুবিধাজনক হচ্ছে, ক্রিকেট খেলে সীমিতসংখ্যক দেশ। এটি মূলত কমনওয়েলথভুক্ত দেশের খেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সীমিত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় দলগুলো বছরজুড়ে একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত খেলছে। কেউ কারও অপরিচিত নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নাড়ীনক্ষত্র জানে। সেটা জানা হয়ে গেলে দল বা খেলোয়াড়ের আলাদা কোনো রহস্য থাকে না। সে অনুযায়ী কলাকৌশল প্রয়োগ করে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে।

টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের কোনো না কোনো সংস্করণে প্রতিটি দেশকেই হারিয়েছে বাংলাদেশ। যে কোনো দলকেই হারিয়ে দেয়ার শক্তি ও সামর্থ্য তাদের আছে। কাউকে জুজুর ভয় পাওয়ার কারণ নেই। একটা সময় দলগুলোর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকলেও এখন তা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। হাল আমলে যে কোনো দলই প্রতিপক্ষকে হারানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর কারণ হতে পারে, শক্তিশালী দলগুলো দুর্বল অথবা দুর্বল দলগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

এখন আর কোনো দলের জয় কিংবা পরাজয়কে সাধারণত অঘটন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় না। ধরে নেওয়া হয়, এমনটি হতেই পারে। তা ছাড়া ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা হওয়ায় কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না, তারা জিতবেই। উভয় দলেরই জয়ের সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকে।

তাহলে বাংলাদেশ কেন আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ, আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, আইসিসি মেন্স টি-টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হতে পারছে না? এটা একটা প্রহেলিকা হয়ে আছে। ক্রিকেটে যত বেশি খেলা হয়, ততই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দেয়া বাংলাদেশের কখনো না কখনো বড় সাফল্য পাওয়াই কথা।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ক্রিকেটাররা অভিজ্ঞ হওয়ার পর দলীয় সাফল্য কেন যেন দূরে সরে যেতে থাকে। দ্বিপক্ষীয় ম্যাচ বা সিরিজ জয় এবং ব্যক্তিগত কিছু নৈপুণ্য প্রদর্শিত হলেও স্বীকৃত বড় প্রতিযোগিতায় সাফল্য আসছে না। এর কারণ কি এই, অভিজ্ঞ হয়ে গেলে দলের চেয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবই প্রাধান্য পায়। তা যখন বড় হয়ে ওঠে, তখন নিজেদের পরিবর্তে খেলেন নিজের খেলা। অর্থাৎ হিসাবি খেলা খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান যত সমৃদ্ধ হবে, দেশ-বিদেশে নিজের কদর ততই বাড়বে। কার্যত দলে নিজের অবস্থান সুসংহত করাই কী হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য? নতুবা এত দিনেও কেন বাংলাদেশ পূর্ণাঙ্গ একটি দল হয়ে উঠতে পারছে না? সেটা না পারায় এতগুলো বছর পেরিয়ে এলেও শিরোপার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।

তরুণদের সাফল্য পাওয়ার কারণ বোধকরি একদমই বড়দের বিপরীত। তাদের পরিচয়ের বলয় সেভাবে গড়ে ওঠে না। অনেকটাই অপরিচিত অবস্থায় খেলতে যান। সঙ্গত কারণেই আত্মপ্রকাশের জন্য মুখিয়ে থাকেন। বয়সোচিত কারণে একে অপরের প্রতি বাড়িয়ে দেন সমঝোতা ও সহযোগিতার হাত। তাদের একটাই টার্গেট থাকে। দলের সাফল্য। মনে করেন, দলের সাফল্য মানেই তার বা তাদের সাফল্য।

এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এক মন এক প্রাণ হয়ে খেলেন। ব্যক্তিগত কোনো হিসাব-নিকাশ মাথার মধ্যে সেভাবে কাজ করে না। যে কারণে দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে কার্পণ্য বোধ করেন না। ভয়ডরহীনভাবে লড়াকু মনোভাব নিয়ে খেলেন। হয় এসপার নয় ওসপার। মারকুটে এই মেজাজের কারণে তরুণরা পেরেছেন চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাতে।

প্রধানত, বিপরীতমুখী মনমানসিকতার কারণে তরুণরা সাফল্য পেলেও বড়রা পাচ্ছেন না। অবশ্য গড়পড়তা সবাইকে একই গোয়ালের গরু ভাবার কারণ নেই। কারও কারও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকে দলের সাফল্যে অবদান রাখার। হয়তো ব্যাটে-বলে ঠিকমতো হয় না। এটাও মনে রাখতে হবে, ক্রিকেট শুধু টিমগেম নয়, একটি সংবেদনশীল খেলা। কোথাও ছন্দ কেটে গেলে তার প্রভাবে পুরো দলের ওপর পড়া অস্বাভাবিক নয়।

সে ক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খেলোয়াড়দের মনমেজাজ বুঝে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া কিংবা সমর্থন দেয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। শুধু হুকুমদারি করে বড় সাফল্য পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া বহিরাবরণ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না, দলের অন্তরটাকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। সেই আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে একদিন ক্রিকেটের বড় আসরে উড়তে পারে বাংলাদেশের পতাকা।

দুলাল মাহমুদ: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ