Views Bangladesh Logo

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও কেন নাগরিক উদ্বেগ বাড়ছে!

Rahman  Mridha

রহমান মৃধা

মরা, সাধারণ নাগরিকগণ এই প্রথমবারের মতো একটি গণভোটবিহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দিয়েছি- যা সংবিধান অনুযায়ী হয়তো কিছুটা বিতর্কিত; কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে একে প্রয়োজনীয় বলেই মেনে নিতে হয়েছে। কারণ, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ কখনোই একটি পূর্ণাঙ্গ, কার্যকর ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সা, দুর্নীতি, গুম-খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা দেশকে এক গভীর আস্থাহীনতার খাদে ঠেলে দিয়েছে।

এই অন্তর্বর্তী সময়কে কেবল একটি নির্বাচন ব্যবস্থাপনার সুযোগ হিসেবে দেখা যাবে না। বরং এটিকে হতে হবে একধরনের আত্মসমালোচনার সময়- যেখানে আমরা পর্যালোচনা করবো কোন কোন জায়গায় রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং সেই ভাঙনের মুখে নতুন রাষ্ট্রচিন্তা কী হতে পারে। এ মুহূর্তে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে সাহসী পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাও একরকম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেই বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের এই ক্ষুদ্র পর্যালোচনা-

১. বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসনের সংকট
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক বেদনার জায়গা হলো- বিচারহীনতার সংস্কৃতি। গুম, খুন, ধর্ষণ বা দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও অনেক সময় তার তদন্ত হয় না, বা বছর বছর মামলা ঝুলে থাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য। এ অবস্থায় জনগণের মাঝে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের আহ্বান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দেয়। প্রভাবশালী অপরাধীরাও যেন আইনের বাইরে না থাকে এবং প্রতিটি বিচারপ্রার্থী যেন ন্যায়বিচার পায়- এটাই হওয়া উচিত নতুন রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম ধাপ।

২. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক শান্তি নয় বরং গণতন্ত্রের ভিত্তি গঠনের পূর্বশর্ত; কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি রাজনৈতিক প্রভাবে চালিত হয়, তবে সেই ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারকে নির্বাচন কমিশনের প্রতি পূর্ণ স্বাধীনতা, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা এবং নীতিগত নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে- যাতে তারা কোনো দলীয় চাপ ছাড়াই তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন। জনগণ যেন বুঝতে পারে, এবার সত্যিই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আসছে।

৩. প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি
দলীয়করণ, প্রভাবশালী নিয়োগ ও রাজনৈতিক আনুগত্য দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের পেশাদারিত্ব নষ্ট করেছে। এর ফলেই আমরা দেখি, মাঠপর্যায়ে সেবাপ্রদান ব্যাহত হয় এবং দুর্নীতি অনায়াসে গোঁড়ায় বাসা বাঁধে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখনই উচিত একটি নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসন গঠনের সূচনা করা যেখানে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি হবে যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে- not রাজনৈতিক আনুগত্যে। এই সংস্কার না হলে যে কোনো নির্বাচনেরই ফলাফল হয়ে পড়বে অস্থায়ী ও ভঙ্গুর।

৪. ডিজিটাল নজরদারি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু অধিকার নয়- রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার প্রতিফলন; কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অনলাইন পর্যবেক্ষণ ও নানা হয়রানিমূলক মামলার ফলে নাগরিকদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে এই নীতিগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা, ডিজিটাল বাংলাদেশকে “গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে” রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়া- যেখানে সত্য বলা হবে অপরাধ নয়, বরং নাগরিক কর্তব্য।

৫. শিক্ষায় নৈতিক ও নাগরিক মূল্যবোধের অভাব
দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রগঠনে শিক্ষাই সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার; কিন্তু আমাদের পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দায়িত্ববোধের শিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত। এই শূন্যতা থেকেই তৈরি হচ্ছে সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা ও অনৈতিক আচরণের সংস্কৃতি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি দূরদর্শী পদক্ষেপ হতে পারে- পাঠ্যক্রমে নাগরিক শিক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে একটি নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা। এটিই হবে সত্যিকারের জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা।

৬. প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
প্রবাসীরা শুধু রেমিট্যান্স প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে না, তারা অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও আসেন- যা রাষ্ট্র পরিচালনায় দারুণভাবে কাজে লাগতে পারে; কিন্তু আজও তারা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে প্রান্তিক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে প্রবাসীদের সঙ্গে একটি নিয়মিত ও গঠনমূলক সংলাপ চালু করা এবং নীতিনির্ধারণ ও সংস্কারে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা। একটি উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এই বিশাল মানবসম্পদ উপেক্ষা করা আত্মঘাতী হতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনসমর্থন ছিল একটি আশাবাদের প্রতিচ্ছবি- নতুন কিছু দেখার, কিছু পরিবর্তনের প্রত্যাশা; কিন্তু এই সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অদূরদর্শী এবং সমন্বয়হীন কর্মকাণ্ডের ফলে মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ যখন দেখতে পায়, একই পুরোনো পদ্ধতিতে প্রশাসন চলছে- যেখানে জবাবদিহি নেই, জনপ্রতিনিধিত্ব নেই, দুর্নীতি কমছে না বরং বাড়ছে- তখন সেই মানুষ কীভাবে এই সরকারে আস্থা রাখবে?

আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা জনগণই এই রাষ্ট্রের মালিক। শাসনব্যবস্থা আমাদের ইচ্ছার প্রতিফলনেই পরিচালিত হওয়া উচিত। প্রশাসন ও সরকার- উভয়ই আমাদের সেবা করার জন্য নিযুক্ত, আমাদের ওপর ক্ষমতা ফলানোর জন্য নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই মৌলিক সত্যটি আমাদের প্রশাসন হয়তো এখনো পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি।

ড. ইউনূসের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন: দেশের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে বাস্তবিক ও কার্যকর করে তুলুন। দুর্নীতির মূলে যে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক যোগসাজশ তা চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যারা গুম, হত্যা, সন্ত্রাস বা নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন- তবে সেটি যেন হয় আইনানুগ এবং মানবাধিকারের মানদণ্ড বজায় রেখে।

আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই: গণতন্ত্রের অর্থ কেবল নির্বাচন নয়- এর অর্থ নাগরিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের জবাবদিহি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সত্যিই একটি স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন আয়োজন করতে চায়, তবে আগে রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের পাশে দাঁড় করাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর যদি সত্যিকারের গণতন্ত্রে আস্থা থাকে তাহলে তাদের আচরণেও তার প্রতিফলন ঘটতে হবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজ তারা নিজেরাই গণতন্ত্রবিরোধী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে- তাহলে জনগণ কীভাবে তাদের ওপর আস্থা রাখবে?

আমরা মনে করি, এই সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুধু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নয়- বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বাধীন এবং মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করা। এজন্য আপনাদের চাই প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক সাহস এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা। নইলে এই সরকারও পূর্বতন ব্যর্থ শাসনগুলোর মতো ইতিহাসে হারিয়ে যাবে। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে সত্য কথা বলা ভয় নয়, কর্তব্য হয়ে উঠবে।

এই মুহূর্তে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদিচ্ছা, দূরদর্শিতা এবং সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর। আপনারা যদি এই ঐতিহাসিক দায়িত্বকে আন্তরিকতা ও জনকল্যাণের সঙ্গে পালন করেন তবে হয়তো এই প্রথম বাংলাদেশ একটি বাস্তব গণতন্ত্র, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও নাগরিক মর্যাদার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে। এই সরকার কেবল একটি নির্বাচন আয়োজনের প্রযুক্তি হোক না- বরং হয়ে উঠুক একটি নৈতিক দৃষ্টান্ত যা ভবিষ্যতের সব শাসক ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও জবাবদিহিমূলক থাকতে বাধ্য করবে।

আমরা সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখি যা জন্ম নিয়েছিল বাংলার প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগ ও আদর্শের মধ্যে- যেখানে মানুষের অধিকার কখনো পায়ের নিচে পিষ্ট হবে না, বাক-স্বাধীনতা হবে পবিত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্র হবে ভয় নয়, ভরসার প্রতীক। আমরা চাই এমন এক বাংলাদেশ যেখানে শিশুদের ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন নয়, যেখানে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী নয় বরং রাষ্ট্রই হবে জনগণের সেবক। সেই সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এ পথ চলায় যেন ভুলে না যান- ক্ষমতা আপনারা ধার নিয়েছেন, মালিক কিন্তু জনগণ।

রহমান মৃধা: গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ