লোডশেডিং বাড়লেই কেন মনে হয় ৮টায় দোকান বন্ধ করতে হবে!
চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। এই দেশে প্রতিদিন সন্ধ্যার মধ্যে বিপণিবিতান অর্থাৎ দোকান-পাট বন্ধ করার নিয়ম মানতে হয়। এই নিয়ম মানা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। সন্ধ্যা মানে সন্ধ্যাই, সে ৫টা হোক কিংবা ৬টা। ইউরোপ এবং আমেরিকায় একই নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সন্ধ্যা নামার পর আর কেউ কেনাকাটা করে না। দোকানপাট খোলা রাখা হয় না। অর্থাৎ শিল্পোন্নত কোনো দেশই সন্ধ্যার পর আর মার্কেট খুলে রাখে না। তাহলে আমরা কেন রাত ৮টায়ও দোকান বন্ধ করতে পারি না? রাত ৮টায় দোকান বন্ধ করতে গেলে সরকারকে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়! বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো অভিযান পরিচালনা করলে রাত ৮টায় দোকান বন্ধ হয়। অভিযান থেমে গেলে রাত ১০টার আগে কেউ দোকান বন্ধ করে না। অন্যদিকে সরকারও দোকান বন্ধের বিষয়ে কড়াকড়ি করে কেবল লোডশেডিং বাড়তে থাকলে।
রাজধানীতে এমন কিছু বিপণিবিতান রয়েছে, যেগুলোর বিদ্যুৎ খরচ কোনো কোনো ছোটখাটো জেলার সমান। অর্থাৎ গোটা একটি জেলা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, এসব বিপণিবিতান সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে চালাতে হয়। জেলাগুলোতে লোডশেডিং হলেও বিপণিবিতানে লোডশেডিং হয় খুবই কম। অর্থাৎ তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় লোডশেডিং মুক্ত রাখা হয়।
চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি তারা যদি সন্ধ্যার আগে কোনাকাটা শেষ করতে পারে আমরা কেন পারি না। চীনকে এক রোখা কঠোর বলে হয়তো অন্যরা সমালোচনা করতে পারেন; কিন্তু ইউরোপ দেশগুলোতে প্রায় ৭৪ কোটি মানুষ বসবাস করেন। তারাও তো সন্ধ্যা নামার আগেই কেনাকাটা সারেন। প্রায় ৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাষ্ট্রও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট বিপণিবিতান বন্ধ করে দেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু জায়গা খোলা থাকলেও মোটাদাগে সন্ধ্যার মধ্যে দোকান বন্ধের অভ্যাস গড়ে উঠেছে দেশগুলোতে।
আমাদের দেশে আমরা কেন এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারিনি। প্রথমত, মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই এমন কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ অফিস আদালত কিংবা বাড়ির সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যা কিংবা বিকেলে মার্কেটে যায়। ৮টা-৯টা পর্যন্ত কেনাকাটা করে খেতে বসলে আরও এক দুই ঘণ্টা চলে যায়। আর বাসায় ফিরলে তো ফিরেই আসলেন। প্রধান দুই উৎসব ঈদের আগে অন্তত ১৫ দিন দোকান বন্ধের সব সময়সীমা তুলে দেয়া হয়। উৎসবের জন্য এমন আয়োজন থাকতেই পারে; কিন্তু সারা বছর যদি দোকান খোলা রাখার এমন সিদ্ধান্ত সবাই নিয়ে বসে থাকেন, তাহলে তো মুশকিলই বলতে হবে।
রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোর বড় বিপণিবিতানে দোকান বন্ধের নির্দেশনা মানা হলেও শহরের অন্য কোনো জায়গার দোকান বন্ধের বিষয়ে কাউকে বাধ্য করা যায় না। একটি পাড়ার মোড়ের মুদি দোকান কেন রাত ১১টা পর্যন্ত খুলে রাখতে হবে। কিংবা অলিগলির মধ্যের কাপড়ের দোকান কিংবা সুপারশপগুলো কেন ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে!
গত কয়েকদিন ধরে দেশে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে সরকারিভাবেই দেশে ২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হওয়ার তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি); কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির হিসাবে এই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি।
উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকার পরও কেন লোডশেডিং করা হয়? এমন প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির ব্যবস্থাপনার দিকে তাকাতে হবে। এখন প্রতিদিন আমরা যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি তার মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ করা হয় আমাদের দেশীয় জ্বালানি কয়লা এবং গ্যাস দিয়ে। বাদবাকি বিদ্যুতের অর্থাৎ প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় আমদানি করা কয়লা, গ্যাস এবং তেল দিয়ে। অর্থাৎ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬৬ ভাগ উৎপাদন হয় আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে। এ ছাড়া এখন প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যয় মেটাতে হয় ডলারে। অর্থাৎ বিদ্যুতের উৎপাদন এবং আমদানি বৃদ্ধি করলে বেশি ডলার প্রয়োজন পড়বে।
এখন এই লোডশেডিং থেকে মুক্তির প্রধান উপায় হচ্ছে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার একটি বড় জায়গা হচ্ছে সময়মতো বিপণিবিতান এবং দোকানপাট বন্ধ করা। এই নিয়ম শুধু রাজধানী কিংবা বড় শহরে মানলেই হবে না। এটি সারা দেশের মানুষকে মানাতে হবে। তাহলেই অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। এই সাশ্রয় করা বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেই দেশে আর লোডশেডিং থাকে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল গত বছর ৮টায় দোকান বন্ধের পর বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের যে হিসাব দিয়েছিল সেখানে ২ হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয়ের হওয়ার কথা জানিয়েছিল। এটি জানার পরও কেন সরকার সারা বছর বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের এই নীতিতে কঠোর থাকল না, সেটি বলা কঠিন। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে কেবল গরমে মানুষ লোডশেডিং নিয়ে কষ্ট পেলেই রাত ৮টায় দোকান বন্ধের বিষয়ে সরকার কঠোর হয়।
এখন সারা দেশে মোটামুটি ১০টার পর থেকে দোকান বন্ধ হতে শুরু করে; কিন্তু সরকার যদি সন্ধ্যার পরপরই দোকান বন্ধের বিষয়ে কঠোর হয় তাহলে প্রতিদিন এই ২ হাজার মেগাওয়াটের জায়গায় ৪ হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয় হয়। এই সাশ্রয় কেবল গ্রীষ্মে নয়, সারা বছর করতে হবে। তাহলে প্রতি দিন ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলে ৩৬৫ দিনে ৭ লাখ ৩০ হাজার মেগাওয়াট/আওয়ার বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। গড়ে যদি এক দিনে ১৫ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা হয় তাহলে এই বিদ্যুৎ দিয়ে ৪৮ দিন চলা সম্ভব।
আমরা কি সবাই মিলে বলতে পারি না, যা কিছু কিনব সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই কিনব। তাহলে দেশের যেমন সাশ্রয় হবে। আমাদেরও লোডশেডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা কমবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে