বিএনপি কেন ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায়?
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরে ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, বিএনপিও সেই সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার। কেননা যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এই সরকার গঠিত হয়েছে, বিএনপি তাদের অন্যতম। উপরন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পরে বিএনপিকেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ তথা ঠিক কবে নির্বাচন হবে- এ ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিএনপির খুব দ্রুতই দূরত্ব তৈরি হতে থাকে, যা গত বুধবার (১৬ এপ্রিল) অনেকটাই ‘আউটবার্স্ট’ করলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দেয়া লিখিত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি-বিধান সংস্কারে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব পরিবর্তন জরুরি, তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেও তিনি বলেন, তারা আলোচনায় সন্তুষ্ট নন। তার ভাষায়- ‘সরকারপ্রধান ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন শেষ করতে চান; কিন্তু আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি, ডিসেম্বরের যে কাট অব টাইম, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।’ শুরুতে বিএনপির দাবি ছিল জুলাই-আগস্টে নির্বাচন। গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এ বছরের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘যত বিলম্ব হচ্ছে, তত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। বারবার করে বলছি, আসলে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই।’
কিন্তু বিএনপি এখন জুলাই-আগস্টের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছে ডিসেম্বর। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলো কম সংস্কার চাইলে ভোট ডিসেম্বরে, আর বেশি সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনে। তার মানে এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল যদি মনে করে যে, তারা কম সংস্কার, তথা একটি ভালো নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো মেনে নিয়ে ডিসেম্বরেই নির্বাচন চান- তাহলে সরকার এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দেবে। আর যদি সেটি না হয়, তাহলে আগামী বছরের জুনে। অর্থাৎ সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
ধরা যাক, সরকার আগামী বছরের জুনে বা জুনের মধ্যে নির্বাচন করতে চায়। সেক্ষেত্রেও বিএনপির সঙ্গে তাদের প্রত্যাশিত সময়ের ব্যবধান হয় ছয় মাস। এখন আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বিএনপি এই ছয় মাস কমিয়ে আনতে পারবে কি না, সেটি নির্ভর করছে তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতা এবং তাদের ভোট ও জোটের সঙ্গীদের ঐক্যের ওপর। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন ডিসেম্বরে কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায় বা তারা আগে কেন জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছিল?
এ প্রশ্নে বিএনপির নিজস্ব কিছু জবাব আছে। সেগুলো প্রথমে উল্লেখ করা যাক:
১. ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা: বিএনপি মনে করে, জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, তার প্রধান কারণ বিগত সরকার প্রায় ১৫ বছর ধরে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল। নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতার বাইরে রেখে তাদের নির্মূলের চেষ্টা করেছে। অতএব, দ্রুত মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন।
২. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যাত্রা: বিএনপি মনে করে, দেশে যেহেতু দীর্ঘদিন কার্যকর গণতন্ত্র ছিল না বা গণতন্ত্রের নামে একধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল; উপরন্তু উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করেছে, অতএব, অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে এখন দ্রুত সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি শুরু করা দরকার— যার প্রধান উপায় হচ্ছে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন।
৩. আইনশৃঙ্খলা: বিএনপি মনে করে এবং দেশের সাধারণ মানুষও এটা মনে করে যে, গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার জনমনে স্বস্তি দিতে পারেনি। এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে মব তৈরি হচ্ছে; কিছু ঘটনায় সরকার নিজেই মব উসকে দিয়েছে বা সমর্থন দিয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অতএব, বিএনপি মনে করে, দ্রুত নির্বাচন হয়ে গেলে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। যদিও ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভেতরে একটি ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না- সেটি আরেকটি তর্ক।
৪. অর্থনীতি: সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রেমিট্যান্স বাড়লেও গত ৫ আগস্টের পরে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়েছেন। আর্থিক সংকটে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন। নানা কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশের ব্যাংক খাতে এখনো পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফেরেনি। দেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তাতে খুব বেশি অগ্রগতি আছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু বিএনপি মনে করে অনির্বাচিত সরকারের আমলে বিনিয়োগ থমকে যায়। ব্যবসায়ীরা ভরসা পায় না। ফলে তাদের দাবি, দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানো সম্ভব।
এর বাইরে আরও কিছু কারণে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়- যেগুলো তারা নিজেরা বলছে না। রাজনৈতিক মহলে এগুলো নিয়ে আলোচনা আছে। যেমন:
১. ইউনূস সরকার বারবার দরকার; ড. ইউনূসকে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই; অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনির্বাচিত নয়; রাস্তাঘাটে মানুষ বলে আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) পাঁচ বছর থাকুন- এরকম নানা কথা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা সারজিস আলমও সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন, ড. ইউনূসের মতো একজন মানুষ পাঁচ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন- এটা তার আকাঙ্ক্ষা। ফলে এসব কারণে বিএনপির মধ্যে হয়তো ভয় ঢুকে গেছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন হয়তো সত্যিই পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। যে কারণে তারা বলছে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
২. জাতীয় নাগরিক পার্টি বারবারই বলছে যে, জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যা ও অন্যান্য অপরাধে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলের অভিযুক্ত নেতাদের বিচার ও মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে এনসিপি সেটা মেনে নেবে না। এমনকি সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে তারা নির্বাচনে যাবে না- এমন কথাও বলেছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ফলে বিএনপির মনে এই শঙ্কা আছে যে, যদি সত্যিই বিচার ও সংস্কারে আগে এনিসিপি নির্বাচন মেনে না নেয় তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? নির্বাচন কি দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে যাবে? যদিও বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, এনসিপির অবস্থানটি তাদের রাজনৈতিক। এর সঙ্গে নির্বাচনের রোডম্যাপের সম্পর্ক নেই; কিন্তু সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারে- বিএনপির মনে যেহেতু এই ভয় আছে, ফলে তারা দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর চায় দিচ্ছে।
৩. বিএনপির একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্প্রতি বিএনপির দূরত্ব তৈরি হলেও সেটি কমে আসছে বলে মনে হয়। গত ১৩ এপ্রিল লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তারে ছেলে তারেক তারেক রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতের আমির ও নায়েবে আমির। আর এই সাক্ষাৎ শেষে দেশে এসে জামায়াতের আমির আগামী বছরের রোজার আগেই (ফেব্রুয়ারির শুরুতে) নির্বাচন দাবি করেছেন- যে ডেডলাইনের সঙ্গে বিএনপির ডিসেম্বরের খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিএনপি হয়তো ভাবছে, যেহেতু তাদের দীর্ঘদিনের মিত্রও এখন তাদের ভাষায় কথা বলছে বা তাদের সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে; অতএব, দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ দেয়ার এটিই উত্তম সময়।
৪. যাদের নেতৃত্বে একটি বড় অভ্যুত্থান হলো এবং শেখ হাসিনার মতো একজন প্রভাবশালী শাসকের পতন হলো, সেই তরুণরা অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি বা অন্য কোনো দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে- সেটি সহজে মেনে নেবে, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কেননা তারাই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চাইবে। অর্থাৎ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারলেও তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে চাইবে। সেই নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচনের দিনক্ষণের ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দেবে বলে মনে হয় না। ফলে এটিও বিএনপির ভয়ের একটি কারণ যে, তারা হয়তো ভাবছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দলটি নির্বাচনের উপযোগী হয়ে ওঠা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সময় দেবে; সমর্থন ও সহযোগিতা দেবে- যা নির্বাচনি প্রক্রিয়া বিলম্বিত করবে।
৫. দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির নেতাদের মধ্যে যারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; ব্যবসা বাণিজ্য হারিয়েছেন; দীর্ঘদিন কারাগারে থেকেছেন; পালিয়ে বেড়িয়েছেন- তারা ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরপরেই সারা দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। অনেকেই নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুছিয়ে নিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মতো ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ছেন। নিজেদের মধ্যেই কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত মার্চ মাসে দেশে ৯৭টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৩ জন নিহত হয়েছেন- যাদের মধ্যে ৮৮টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে। চলতি মাসের শুরুতে জাতীয় নাগরিক কমিটির গবেষণার ঊদ্ধৃতি দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, গত আট মাসে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের সংঘর্ষ এবং হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছেন। আরেকটি পত্রিকার খবরে বলা হচ্ছে, গত আট মাসে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে চট্টগ্রাম জেলায়। এই সময়ের মধ্যে সারাদেশে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যত নেতাকর্মী অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছেন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ জনই চট্টগ্রামের। আর এই সংঘাতের মূলে রয়েছে দলীয় পদ-পদবি নিয়ে কাড়াকাড়ি, স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন পরিবহন স্ট্যান্ড, হাটবাজার, ঘাট বা ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো। এররকম অনেক ঘটনায় বিএনপি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। ফলে বিএনপি মনে করে, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, মাঠ পর্যায়ে এই জটিলতাগুলো তত বাড়তে থাকবে। তাতে বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থন কমতে থাকবে। ফলে তারা দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।
৬. আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কেননা প্রতিটি আসনেই একাধিক আগ্রহী প্রার্থী। ফলে বিএনপি হয়তো ভাবছে যে, দ্রুত নির্বাচন হলে এই চাপ মোকাবিলা সহজ হবে।
৭. বিএনপি হয়তো মনে করে, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পুনর্গঠিত হওয়া তথা ঘুরে দাঁড়ানো তত সহজ হবে। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে আসবে কি না বা আসতে পারবে কি না, সেটি এখনো অনিশ্চিত। উপরন্তু শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের মামলায় শাস্তি হয়ে গেলে তারা নির্বাচনে অযোগ্য হবেন; কিন্তু তারপরও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাসহ নানা কারণেই আওয়ামী লীগের শেকড় যেহেতু অত্যন্ত গভীরে এবং শুধুমাত্র প্রশাসনিক আদেশে নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচন কমিশনে তার নিবন্ধন বাতিলের মধ্য দিয়েও যেহেতু আওয়ামী লীগকে নির্মূল করা সম্ভব নয়, ফলে বিএনপি হয়তো ভাবছে যে, যত দেরি হবে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি তত সহজ হবে। সে কারণে বিএনপি মনে করে দ্রুত নির্বাচন হয়ে গেলে আওয়ামী লীগ সেই সুযোগটি পাবে না।
পরিশেষে, ডিসেম্বর আসতে এখনো ৮ মাস বাকি। ফলে যেসব মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, যেমন নির্বাচনটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা; বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান বাতিল করা এবং নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশী শক্তির ব্যবহার বন্ধে আরপিও সংস্কার; দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তার বোধ তৈরি করা; অর্থনৈতিক অবস্থা একটা মোটামুটি স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যাওয়া; সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতো যেসব কালাকানুন নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করে- সেগুলো সংশোধন, প্রয়োজনে বাতিল করা এবং সর্বোপরি কিছু দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐকমত্য গড়ে তোলার যে কাজ- সেগুলো সরকার চাইলে আগামী তিন মাসেই করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে নির্বাচনটি আগামী ডিসেম্বর নয়, বরং অক্টোবরেও করা সম্ভব; কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য; কিন্তু সরকার যদি বিশেষ কোনো দলের প্রস্তুত হওয়ার জন্য অধিকতর সময় দিতে চায়, অথবা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে মাঠে সক্রিয় রেখে এবং নানারকম পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচনটি বিলম্বিত করে আরও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়- তাহলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেটি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, সাধারণ মানুষের জন্যও কল্যাণকর হবে না।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে