Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

তেল নিয়ে তেলেসমাতিতে সরকার নাজেহাল কেন?

Chiroranjan  Sarker

চিররঞ্জন সরকার

বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

ভোজ্যতেল নিয়ে সংকট কিছুতেই কাটছে না। বাজারে হঠাৎ করে বোতলের সয়াবিন তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে গত ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই দাম বাড়ানোর ফলে এখন বোতলের এক লিটার সয়াবিনের দাম নির্ধারিত হয়েছে ১৭৫ টাকা। আর খোলা সয়াবিনের দাম নির্ধারিত হয়েছে ১৫৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৭ টাকা হয়েছে। তবে এ দামে কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকাংশ দোকানে বোতলের সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আর খোলা সয়াবিন তেল নিয়ে এক প্রকারের নৈরাজ্য চলছে। ব্যবসায়ীরা খোলা সয়াবিন তেলের দাম ইচ্ছামতো রাখছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি করছেন।

দেশে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চলছে বেশ কিছু দিন ধরে। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তেলের সংকটও দেখা যায়। ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশেও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে ডিলার বা সরবরাহকারীরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। ফলে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহে সংকট তৈরি হয়। সামনে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে তেল নিয়ে সরকারের আমদানি শুল্কছাড় কোনো কাজেই আসছে না। এতে প্রতিদিনই ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে। সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ১০ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করেছে। এতে করে বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম কমার কথা থাকলেও সেই চিত্র কোথাও নেই।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ালেও বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। প্রতিবেদন মতে, দেশে যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়, এর প্রায় সবকটির দামই আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম ১০০ থেকে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ অন্য পরিবহন খরচ কমেছে। দেশে ডলারের দামও কমেছে। আগে আমদানিতে প্রতি ডলার কিনতে হতো সর্বোচ্চ ১৩২ টাকা করে। এখন তা কমে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে। এসব কারণে আমদানি খরচ কমেছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই আমদানি পণ্যের দাম কমার কথা; কিন্তু বাজারে দাম কমেনি। উলটো আরও বেড়ে যাচ্ছে। ভোজ্য তেলের দাম কমাতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিলেও তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না।

সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার থেকে তেল উধাও করে দেন। তাদের চাপে যখন তেলের দাম লিটার প্রতি ৮টাকা বাড়ানো হয়, তখন রাতারাতি আবার বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে ফিরে আসে। এটা স্রেফ দিনদুপুরে ডাকাতি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে তেলের কোনো সংকটই ছিল না। ফন্দি এঁটে কয়েক দিন ক্রেতার নাভিশ্বাস তুলে সরকারকে জিম্মি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে। অতীতেও ঘটেছে এমন ঘটনা।

আজ তেল, কাল চিনি, পরশু হয়তো অন্য কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সুবিধা নিচ্ছে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। তাতে একদিকে ভোক্তার খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারও চাপে পড়ছে। এখন যেসব তেলের বোতল বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে, সেগুলো কখন আমদানি করা হয়েছে, আমদানি দর কত ছিল, কবে নাগাদ বাজারজাত করা হয়েছে- এসব তথ্য খতিয়ে দেখার কেউ নেই।

বর্তমান তেল সংকটের জন্য কেউ কেউ আঙুল তুলছেন আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানির দিকে, কেউ পাইকারের দিকে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা আগে থেকেই টাকা দিয়ে রাখলেও তেল সরবরাহ পায় না। আবার অনেকে ভোজ্যতেলের সঙ্গে অপ্রচলিত পণ্য কিনতে বাধ্য করার বিষয়টিকে সামনে আনছেন; কিন্তু এর কোনোটি নিয়েই ধারাবাহিক প্রশাসনিক তদারকি নেই।

তেল নিয়ে কারসাজি চলছে অনেক দিন ধরেই। তেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট সব সময় সংকট সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দেখিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী আর মজুতদাররা জানত চাপ সৃষ্টি করলে সরকার তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। অতএব, গুদামজাত করতে পারলে লাভ আর লাভ। তারা সেই কাজটিই করেছে।

বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানি পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। সরকার যদি সয়াবিন তেল আমদানি ‘ওপেন’ করে দিতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আমদানিকারক, তারা তাদের নির্দিষ্ট ডিলারদের দিয়ে সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুত করে এই সংকট তৈরি করছে। অথচ তারা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধিকে তেলের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে।

অতীতেও আমরা দেখেছি, কোনো কিছুর দাম বেড়ে গেলে কিংবা কোনো কিছু বাজার থেকে উধাও হয়ে গেলে সরকারের তরফ থেকে যেনতেন একটা ব্যাখ্যা হাজির করা হয়। বিগত সরকারের সময়ও করোনা এবং যুদ্ধের কারণে মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। তার অনেকটাই সত্য ছিল; কিন্তু সেসব কথা উপলব্ধিতে নেয়নি জনগণ। তাদের চাহিদা খুব বেশি নয়। সে চাহিদা মেটানো যখন কঠিন হয়ে পড়ে, তখন সরকারের সমালোচনাই করে থাকে তারা।

দাম বৃদ্ধির আগে পর্যন্ত বড় মজুতদারেরা তেল ছাড়েননি। যারা তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সঙ্গে সরকারি মহল আলোচনায় বসেছে ঠিকই; কিন্তু দাম বাড়ানোর আগপর্যন্ত সংকটের সুরাহা হয়নি। ভেবে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, ব্যবসায়ী মহলের দাপটের কাছে বর্তমান সরকারও নতজানু!

প্রশ্ন হলো, তেল নিয়ে এই তেলেসমাতি কি চলতেই থাকবে? আর কত মুনাফা হলে টার্গেট পূরণ হবে? দেশে এভাবেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, তাদের পকেট কেটে এক শ্রেণির লোভী মানুষ টাকার কুমিরে পরিণত হচ্ছে। তারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করছে। দেশের বাইরে একের পর এক ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠছে। অজস্র জীবন ও সম্পদের মূল্যের বিনিময়ে সরকার পরিবর্তনের পরও টাকা বানানোর সেই পুরোনো প্রক্রিয়ার অবসান ঘটেনি।

বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে তেল সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার হচ্ছে না। অথচ বিগত সরকারের আমলে এদেরই অনেকে সিন্ডিকেট ভাঙার প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন। তাহলে কি সরকারি গদিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেটবিষয়ক অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে? যে সিন্ডিকেট নিয়ে এত সমালোচনা হলো, এখনো তা টিকে আছে কী করে? কারা সিন্ডিকেট করেছিল বিগত সরকারের আমলে? কেন তাদের বিচার হচ্ছে না? এখনো কেন তেল মজুতকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?

সরকার শুধু ব্যবসায়ীবান্ধব হবে, নাকি ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অর্থাৎ জনবান্ধব হবে, সেই সিদ্ধান্ত দ্রুতই গ্রহণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আবেদন-নিবেদন, কর-রেয়াত, শুল্ক ছাড়ের মতো মামুলি উদ্যোগে কাজ হবে না। প্রয়োজনে পিঠে লাঠির বাড়ি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেমন প্রাণী, মুগুরও তেমনি হওয়া চাই।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ