ব্যাংকিং খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই কেন?
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর অনেক দিন ধরেই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে বিগত সরকার আমলে এই খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ৮ মাস গত হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। এখনো বেশ কিছু দুর্বল ব্যাংক রয়ে গেছে। কিছু কিছু দুর্বল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় টিকে আছে। কিছু কিছু ব্যাংক মোটামুটি চলছে। তবে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা ভালো বলা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাংক আছে যেগুলোকে বাঁচানো সম্ভব নাও হতে পারে।
ব্যাংকিং সেক্টরে নানা সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণের উপস্থিতি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের ছাড়কৃত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে আছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি। এটা ছাড়কৃত মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানে শ্রেণিকৃত হয়ে আছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মন্দমানে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। যেসব ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হয় সেগুলো থেকে কিস্তি আদায়ের সম্ভাবনা খুব একটা থাকে না। বেশ কিছু ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। তারা ইচ্ছে করলেও বিধি মোতাবেক প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ১৩টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটটি রয়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা কতটা খারাপ তা এই পরিসংখ্যান থেকেই অনুমান করা যায়। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংকগুলো ন্যূব্জ হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বিদ্যমান নেই। ফলে ব্যাংকিং খাত দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথযাথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে, যাতে এ খাত দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। ব্যাংক খাতের সহায়তা ছাড়া আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক ব্যবসায়রত রয়েছে। অনেকেই বলেন, আমাদের মতো একটি দেশে এত বেশিসংখ্যক ব্যাংকের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বিষয়টি সেভাবে দেখিনা। কতগুলো ব্যাংক ব্যবসা করছে সেই সংখ্যাটি বড় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, ব্যাংকগুলো কীভাবে চলছে? তারা কি নিজস্ব ক্ষমতাবলে টিকে থাকতে পারছে নাকি কারও দয়ায় টিকে থাকতে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা কী দেখতে পাই?
ভারতের জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির আকার আমাদের তুলনায় অনেক বড়; কিন্তু তাদের সেখানে ব্যাংকের সংখ্যা আমাদের চেয়ে কম। কাজেই সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। বরং দেখতে হবে, ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারছে কি না। আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টর তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। ব্যাংকিং সেক্টরে কি কি দুর্বলতা আছে তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। খেলাপি ঋণের ব্যাপক উপস্থিতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণেই মূলত এই সেক্টর বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা রাখার কথা, তা তারা সঠিকভাবে রাখতে পারছে না। ব্যাংকের মালিক এবং পরিচালনা পর্ষদ এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী মিলিতভাবে ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত হয়েছিল।
সাম্প্রতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ব্যাংকিং খাত মহল বিশেষের অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে বৈধ-অবৈধভাবে ঋণ গ্রহণ করে তা বিদেশে পাচার করেছে। সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে অর্থ পাচারের জন্যই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের সুরক্ষা দেবার জন্য বিভিন্ন সময় ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের যে সংজ্ঞা তা পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টর আন্তর্জাতিক মানের আইন দ্বারা পরিচালিত হতো। সাম্প্রতিক সময়ে সেই সব আইন এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যাতে ঋণ খেলাপিদের স্বার্থ রক্ষা হয়। ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণ, ঋণ হিসাব অবলোপন ইত্যাদি নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। এতে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানো সম্ভব হয়েছে; কিন্তু কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। যারা ব্যাংক খাত ধ্বংসের জন্য লিপ্ত রয়েছেন তারা যাতে তাদের কাজগুলো আরও ভালোভাবে করতে পারেন মূলত এ কারণেই ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তিত আইন ঋণখেলাপিদের সুরক্ষা দিয়েছে কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের জন্য এসব আইন কোনো কাজে আসেনি।
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর মূলত দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন বা ভেঙে দেবার ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন বা পরিবর্তনসহ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ-বরখাস্তের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে পুরো ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছে করলেই সব ব্যাপারে তার ভূমিকা রাখতে পারে না।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি নতুন ব্যাংক স্থাপনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল; কিন্তু সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, দেশে এই মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের আবশ্যকতা নেই; কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আবশ্যকতা বিবেচনা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপন করা হলে তার পরিণতি কি হয় তা আমরা বেশ ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করেছি। রাজনৈতিক বিবেচনায় যে ৯টি ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশই ভালোভাবে চলছে না। ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে দ্বৈত ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যাংকিং ব্যবসায় সাধারণ ব্যবসায়ের মতো নয়। ব্যাংক চলে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থে। তাই সেখানে সর্বোচ্চ সততা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হয়। ব্যাংকের উদ্যোক্তা বা মালিকরা নিজের অর্থে ব্যবসায় করেন না। তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করেন। সেই আমানতের বিপরতীতে আমানতকারীদের নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। আর সংগৃহীত অর্থ উদ্যোক্তাদের নিকট বিনিয়োগ করে ব্যাংক মুনাফা অর্জন করে। কোনো কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর আমানতকারীদের আস্থা কমে গেছে অথবা বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেলে ব্যাংক ব্যবসায় ধস নামতে বাধ্য। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্র বিশ্বাস বা আস্থা ধরে রাখাটা বেশ কঠিন। ব্যাংক সেই কঠিন কাজটিই করে থাকে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া, নীতি প্রণয়ন করা এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
যেসব ব্যাংক ভালোভাবে চলছে না সেগুলোর ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ প্রশ্নটি মাঝে মাঝেই উত্থপিত হয়। সাধারণভাবে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যদি লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে না পারে তাহলে সেই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে একটি প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় সাপোর্ট দিয়ে টিকিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকিং ব্যবসায় টিকে থাকার সামর্থ্য অর্জন করার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। তারা যদি তা করতে না পারে তাহলে অবসায়নের পথেই যেতে হবে। অবশ্য কোনো শক্তিশালী ব্যাংক ইচ্ছে করলে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অধিগ্রহণ বা আত্মীকরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া একটি ব্যাংক অন্য একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ করা হলে অধিগ্রহণ করা হলেই যে ভালোভাবে চলবে তা নাও হতে পারে।
ব্যাংকিং ব্যবসায় যেহেতেু ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান তাই তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে যে কোনোভাবেই হোক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকে থাকার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। অন্যথায় চলে যেতে হবে। তবে ব্যাংকের অবসায়ন বা অন্য যে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেনো আমানতকারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমানতকারীদের অর্থ নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারল্য সহায়তা দিচ্ছে; কিন্তু এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে না। ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব শক্তিগুণেই টিকে থাকতে হবে। অন্যথায় চলে যেতে হবে।
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস), সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে