চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজের জন্য আইএমডিবি রেটিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের ছোটবেলায় ক্যাসেট এনে ভিসিআরে সিনেমা দেখার দিনগুলোতে কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল না কোন ছবিটা কেমন? কারণ তখন ছবিই দেখতাম হাতে গোনা দু-চারটি, আর যেসব ছবি দেখতাম, তা আগে থেকেই বাজারে চাউড় থাকত, পাড়ার মোড়ে মোড়ে অডিও-ভিডিওর দোকানে ছবিগুলোর গান বাজত, লোকের মুখে মুখে ছবির গল্প ঘুরত। বলার অপেক্ষা রাখে না, তখন হিন্দি ছবিই দেখা হতো বেশি। হলিডের দু-চারটা মারদাঙ্গা ছবি দেখলেও সেগুলো থাকত খুব পরিচিত। ফলে দেখার জন্য কারও মুখে শুনে আর ছবি বাছাই করার ঝক্কি ছিল না।
সিডি যখন এলো তখনো অনেকটা এই অবস্থা, তবে তখন বন্ধু-বান্ধব দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করতে হতো কোন ছবিটা কেমন। কারণ, সিডিযুগে প্রবেশের পর বাংলাদেশে বিশ্বের ছবি আমদানি বেড়ে যায়। হলিউড-বলিউডের সঙ্গে ইউরোপ-ইরানি-থাইল্যান্ড-চীন-দক্ষিণ কোরিয়ারও অনেক ছবি আসতে থাকে। কাভার দেখে তো আর সব ছবি কেমন বোঝার উপায় নেই, যদিও অনেকে সিডিতে ছবির সংক্ষিপ্ত কাহিনি সংক্ষেপ থাকত। তাও কত আর দেখে-পড়ে-বুঝে আনা যায়। বেশির ভাগ সময় তখন বন্ধুদের মতামতই ছিল ভরসা।
এখন, এই ইন্টারনেটের অবাধ যাতায়াতের যুগে, যখন অসংখ্য ওটিটি মাধ্যম হাতের মুঠোয়, তখন কোনো চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ দেখতে হলে আপনাকে আর কেবল বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনদের ভরসা করলে হবে না, কারণ এত চলচ্চিত্র, এত সিরিজ কে কোনটা দেখেছে ,তার খোঁজই আপনি বের করতে পারবেন না! এক নেটফ্লিক্সে ঢুকলেই আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। হাজার হাজার চলচ্চিত্র, ওয়েব-সিরিজ তাদের সংগ্রহে। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন! দু-চারটের কথা হয়তো জানবেন পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বেশির ভাগ সম্পর্কেই আপনার ধারণা থেকে যাবে অজানা। আপনি তখন কী করবেন?
আজকাল সহজ উপায় আইএমডিবি (Internet Movie Database)-এ ঢুকে রেটিং চেক করা। শুধু রেটিং না, আপনি ছবির কাহিনিকার, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ অন্যান্য কারিগরিদের সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবেন। তাকে যদি আপনি আগে নাও চিনেন, জানতে পারবেন তার দেশে, বা বিশ্বে, বিশ্বের দর্শকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কীরকম।
আইএমডিবি হলো বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচিত্রবিষয়ক ওয়েবসাইট। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন চলচ্চিত্রের তথ্যভান্ডার। বিশ্বের যত বিখ্যাত সিনেমা, টেলিভিশন সিরিজ, পডকাস্ট, ভিডিও গেমস এবং ইন্টারনেট স্ট্রিমিং কনটেন্ট সম্পর্কিত তথ্য- তার সবই প্রকাশ করে আইএমডিবি। এই রেটিং মানে একটি মনগড়া মান-নির্ধারণ না, এটা নির্ধারিত হয় দর্শকেরই ভোটের ভিত্তিতে। পছন্দের ভিত্তিতে যে কোনো দর্শক ১ থেকে ১০ পর্যন্ত রেটিং দিতে পারে, তার মধ্যে গড় রেটিং নিয়ে মোট রেটিং নির্ধারিত হয়।
যেমন ধরুন, এখন পর্যন্ত আইএমডিবি তালিকায় এক নম্বরে থাকা ছবির নাম ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’। গত ১২ বছর ধরে আইএমডিবির তালিকায় সেরা অবস্থান ধরে রেখেছে এই সিনেমা। বিখ্যাত এই মুভিটি পরিচালনা করেছেন ফ্র্যাংক ড্যারাবন্ট। সিনেমাটি জেলখানা থেকে মুক্তির কাহিনি। সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৯ দশমিক ৩/১০। আপনি যদি এই ছবিটির রেটিং পদ্ধতি দেখতে চান তাহলে আইএমডিবি ওয়েবসাইটে ঢুকে ছবির নাম দিয়ে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসবে। এই ছবিটি ১০-এ ১০ রেটিং পেয়েছে ৫৪ দশমিক ৯ ভাগ দর্শকের কাছ থেকে, আর এই দর্শকের সংখ্যা ১৬ লাখ। আর ১০-এ ৯ দিয়েছে ৭৫৯ হাজার মানুষ, যাদের মোট রেটিং ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
এভাবে ছবিটিতে মাত্র ১ রেটিংও দিয়েছে কেউ কেউ, তাদের মোট দর্শক মাত্র ৪৩ হাজার। অর্থাৎ রেটিংয়ে তারা ১ দশমিক ৫ ভাগ। ফলে ছবিটির মোট গড় রেটিং দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩-এ। এ রেটিং কিন্তু সপ্তাহে সপ্তাহে বদলায়। চাইলে আপনি ঢুকে ছবিটির রেটিং দিতে পারেন। আইএমডিবি রেটিংয়ে এগিয়ে থাকা আরো কিছু বিশ্ববিখ্যাত ছবি হলো- দ্য গড ফাদার, দ্য ডার্ক নাইট, টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান ইত্যাদি।
বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে আইএমডিবি আগে খুব এটা পরিচিত না হলেও এখন খুব জনপ্রিয়। বাংলাদেশি বিভিন্ন সিনেমার তথ্যও জায়গা করে নিয়েছে এ সাইটে। সিনেমা মুক্তির পর থেকেই হাজারো ভক্ত সিনেমাগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে উঠছেন। প্রিয় বাংলাদেশি ফিল্ম নিয়েও রেটিং দিচ্ছেন। আইএমডিবিতে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া বাংলাদেশি ছবি হলো অমিতাভ রেজা চৌধুরি পরিচালিত ‘আয়নাবাজি’।
যাই হোক, সে অনেক কথা। আইএমডিবি নিয়ে জানতে চাইলে আপনি নিজেই ঢুঁ মারতেন আইএমডিবির ওয়েসসাইটে। আইএমডিবি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু তথ্য এখানে জানানো হলো- প্ল্যাটফর্মটি ফ্যান অপারেটেড মুভি ডেটাবেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৯৯০ সালে। ১৯৯৮ সাল থেকে এই ওয়েব সাইটটি ‘অ্যামাজনের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কার্যক্রম চালু করে। ২০২২ সালের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী, ওয়েবসাইটটি প্রায় ১০ দশমিক ১ মিলিয়ন টাইটেলড কনটেন্ট এবং প্রায় ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির তথ্য প্রকাশ করেছে। বর্তমানে এই ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮৩ মিলিয়ন।
আইএমডিবি নিবন্ধিত ব্যবহারকারীরা মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা বা অন্য কনটেন্টের শিরোনামে (১ থেকে ১০ পর্যন্ত) ভোট দিতে পারেন। পৃথক ভোটগুলোর সমষ্টিগত ফলাফলটি আইএমডিবি রেটিং হিসেবে প্রকাশ করা হয়। সাধারণত ৭ প্লাস রেটিংয়ের কনটেন্টগুলোকে ‘ভালো’ বলা হয়ে থাকে। যদিও জনরায়ের ভিত্তিতে এই রেটিংয়ের ভিন্নতা থাকতে পারে৷ সাধারণত দেখা যায়, থ্রিলার অ্যাকশন ঘরানার কনটেন্টগুলো সাধারণ ৮ প্লাস রেটিং হলে তাকে ভালো কনটেন্ট বলা হয়। আবার কখনো কখনো কাহিনি, চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে কম রেটিং প্রাপ্ত অ্যাকশনধর্মী সিনেমাগুলো দর্শকনন্দিত ও জনপ্রিয় হতে দেখা যায়।
রোমান্টিক, কমেডি, কামিং অব এজ ড্রামাধর্মী চলচ্চিত্র বা সমালোচক নন্দিত ধীরগতির সিনেমাগুলো ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে কোনো কোনো ইউজার বেশি রেটিং দিয়ে থাকলেও তা জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। দর্শকদের ব্যক্তিগত অভিমতের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কোনো দর্শক সিনেমা দেখা এমনকি জনরায় বাছাইয়ের জন্য আইএমডিবি রেটিংকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কোনো দর্শক আবার রেটিংকে গুরুত্ব না দিয়ে টিজার বা ট্রেইলারের ভিত্তিতে সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন।
তেমনি আবার পছন্দের তারকা বা ফ্র্যাঞ্চাইজি সিনেমাগুলোর জনপ্রিয়তা রেটিংয়ের ওপর নির্ভর করে না। এ ছাড়াও ‘আন্ডাররেটেড’ বা ‘ওভাররেটেড’ শব্দগুলোর ক্রমাগত ব্যবহারে আন্দাজ করা যায় যে ব্যক্তিগত পছন্দের কাছে রেটিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানিই প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকেই মনে করে শিল্পকে সংখ্যাদ্বারা বিচার করা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি নয়। সেই সঙ্গে রেটিং প্রাধান্য পাওয়ার কারণে কোনো কনটেন্ট দর্শক জনপ্রিয়তা পাওয়ার সুযোগ হারাতে পারে। এ ছাড়াও আইএমডিবির অধিকাংশ নিবন্ধিত ব্যবহারকারী পুরুষ, যে কারণে নারীকেন্দ্রিক বা নারী-পরিচালিত সিনেমাগুলোর কম রেটিং পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
ওয়েবসাইটটির জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতার মূল কারণ হলো তাদের নির্ভরযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন রেটিং ব্যাবস্থা। তাই কনটেন্ট প্রাচুর্যের যুগে এর সঠিক ব্যবহারে এই প্ল্যাটফর্মটির বিকল্প মেলা মুশকিল। তবে, যাই হোক, আজকের বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের যুগে আইএমডিবি রেটিংই হলো একটি পছন্দের চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ খুঁজে নেয়ার সহজতম উপায়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে