অমর একুশে বইমেলা কেন বিশ্বব্যাপী অনন্য
শুরু হয়েছে সৃজনশ্লীল প্রকাশনা শিল্পে এশিয়ার মধ্যে সবচয়ে বড় অনুষ্ঠান অমর একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চটের ওপর অল্পকিছু বই সাজিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা এই বইমেলার সূচনা করেন, সময়ের পরিক্রমায় আজ তা সুবিশাল মেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলাও এখন বিশ্বে দীর্ঘকালব্যাপী আয়োজন হিসেবে অনন্যতা লাভ করেছে বলে ধরা হয়। বাংলা একাডেমির ভেতরে অনেক নতুন ভবন এবং অবকাঠামো তৈরি হওয়ার ফলে বইমেলার পরিসর ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাই মেলার চাহিদা মোতাবেক পরিসর ব্যাপ্তির জন্য ২০১৪ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে এই মেলা।
মেলার বড় একটি অংশ বাংলা একাডেমির অপজিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসার ফলে অমর একুশের স্মৃতিবাহী এ মেলাটির ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটেছে। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের বইমেলা প্রধানত বইয়ের বাণিজ্যিক মেলা। তা ছাড়া অন্যান্য দেশের বইমেলার দিকে তাকালে প্রথম চোখে পড়বে পেশাদারিত্ব এবং অর্থনৈতিক আয়োজন। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বা লিপজিগ প্যারিস অথবা লন্ডনের বইমেলা ছাড়াও জেরুজালেম, টোকিও, সিডনি, ম্যানিলা, বুয়েন্স আয়ারস, নতুন দিল্লি কিংবা কলকাতার পুস্তকমেলা এখন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয়, বৈচিত্র্যে ভরা এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মেলার সঙ্গে বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলার কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আসুন, আমরা জেনে নেই কী সেই ভিন্নতা:
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা (জার্মানি):
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় বাণিজ্যিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা কিংবা বইয়ের বাণিজ্যিক হাব। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে কয়েকশ বছর ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে এর শুভ সূচনা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই বইমেলার সূচনা হয় ১৪৬২ সালে। নতুন রূপে এই বইমেলা ফিরে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে। মেলায় প্রায় ৩ লাখ পাঠক-ক্রেতা সমাগম হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলা আয়োজিত হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেড ফেয়ার গ্রাউন্ড-এ।
প্রথম তিনদিন থাকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের জন্য। পরবর্তী দুদিন মেলা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। মেলাটি বিশেষত তিন ভাগে বিভক্ত থাকে– (ক) নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে উপস্থিত থাকেন যারা তাদের জন্য, (খ) মেলায় আসা পাঠক-ক্রেতাদের জন্য, (গ) ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া বিজনেস সেন্টার। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ হল ‘গেস্ট অব অনার’ বা সাম্মানিক অতিথি হিসেবে কোনো এক নির্দিষ্ট দেশের উপস্থিতি। এই বইমেলায় ‘গেস্ট অব অনার’ হওয়াকে প্রতিটি দেশই অত্যন্ত সম্মানজনক মনে করে এবং এর জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিযোগিতাও থাকে।
বুক এক্সপো আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র):
১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘আমেরিকান বুক সেলার অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘কনভেনশন এবং ট্রেড শো’ নামে শুরু হয় বই নিয়ে এই আয়োজন। ১৯৭১ সালে নাম বদলে ‘বুক এক্সপো আমেরিকা’ নাম রাখা হয়। মে মাসের শেষে বা জুন মাসের শুরুতে চার দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে পালাক্রমে চলত এ বইমেলা। ২০০৮-এ লস অ্যাঞ্জেলেস-এ, নিউইয়র্ক সিটিতে ২০০৯-১৫ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ মেলা। ২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারির পর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বুক এক্সপো।
২০২০ সালেই আয়োজক সংস্থা ‘রিডপপ’ ঘোষণা করেছিল ‘বুক-এক্সপো’ ও সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে শুরু হওয়া জনপ্রিয় দুটি ইভেন্ট ‘দ্য বুককন’ ও ‘আনবাউন্ড’ আপাতত ‘অবসর’ নিচ্ছে। ২০২২-এর মে মাসে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউএস বুক শো’, যা ২০২১ সালে শুরু করেছিল পাবলিশার্স উইকলি ‘বুক এক্সপো’র বিকল্প হিসেবে। তবে অদূর ভবিষ্যতে ‘অবসর’ ভেঙে ‘বুক এক্সপো’-র ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না।
লন্ডন বুক ফেয়ার (ইংল্যান্ড):
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা হলো ইংল্যান্ডের লন্ডন বুক ফেয়ার। ১৯৭১-এর ৫ নভেম্বর এ মেলার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি দেশ লন্ডন বইমেলায় অংশ নেয়। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে আয়োজিত হয় এই মেলা। ইউরোপিয়ান প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্টদের বিরাট সমাগম হয় প্রতি বছর এই মেলায়, যার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ মেলা চলতো অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে। মাঝে কয়েক বছর এই মেলার স্থানবদল হলেও ২০১৫ থেকে লন্ডন বুক ফেয়ার চলছে অলিম্পিয়াতেই। প্রায় দুই হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত লন্ডন বুক ফেয়ার-এ তিন দিন ধরে চলে দুশরও বেশি ইভেন্ট যেখানে বিভিন্ন নামজাদা বক্তারা তাদের বক্তব্য রাখেন, থাকে আলাপচারিতা, প্রশ্নোত্তর পর্ব।
আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত):
কলকাতায় এই বইমেলাটির শুরু ১৯৭৬ সালে, আন্তর্জাতিকভাবে হচ্ছে ১৯৮৬ সাল থেকে। যা ১২ দিন ধরে চলে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিচারে, এটি দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বইমেলা। বাংলা বই-ই মূল; অনেক ইংরেজি বইও বিক্রি হয়। ভারতের অন্যান্য ভাষা যেমন হিন্দি, উর্দু ও সংস্কৃতির বইগুলো বিক্রি হয়। বিদেশি দূতাবাসগুলো দেশের স্টল সাজিয়ে বই প্রদর্শনী করেন। পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকারের বাংলা বই বিক্রি হয়। বাংলাদেশের প্রকাশকরা অংশ নেন। তাদের আলাদা জায়গা থাকে, থাকে স্মারক স্থাপত্য। যান বিখ্যাত লেখকরাও। এমনকি পত্রিকার প্রকাশনা বিভাগও অংশ নেয়। শিশু, তথ্যপ্রযুক্তি ও লিটল ম্যাগ, চিত্রশিল্পীদের জন্য আলাদা স্থান থাকে। পশ্চিম বাংলা, ভারত ও বিশ্বের নামকরা লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যব্যক্তিত্ব, অতিথি হিসেবে আসেন ও আলোচনা করেন। থাকে নানা ধরনের বই বিষয়ে অনুষ্ঠান, সেমিনার, পদযাত্রা, প্রতিযোগিতা ও প্রকাশনা। আয়োজন করে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। এই মেলায় উৎসাহিত হয়ে এখন ভারতের নানা জায়গায় বইমেলা শুরু হয়েছে।
অমর একুশে বইমেলা (বাংলাদেশ):
অমর একুশে বইমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে সেই শহীদদের প্রতি, যারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মতো ভাষা শহীদদের স্মরণে উৎসর্গ করা বইমেলার আয়োজন বিশ্ব বইমেলার ইতিহাসে বিরল। ১৯৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সামনে মুক্তধারা প্রকাশনা সংস্থা ছোট পরিসরে বই বিকিকিনি শুরু করে। পরে আরও প্রকাশনা সংস্থা এতে যোগ দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর থেকেই এই মেলার গোড়াপত্তন হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলার আয়োজন করতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলা একুশে বইমেলা এশিয়ার অন্যতম বড় বইমেলা। মেলা চলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। মেলায় রয়েছে স্থায়ী ‘নজরুল মঞ্চ’ যেখানে সারা মাসজুড়ে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রয়েছে ‘লেখক কুঞ্জ,’, রয়েছে ‘লেখক বলছি মঞ্চ’ রয়েছে ‘লিটিলম্যাগ চত্ত্বর’ যেখানে মেলার দিনগুলোতে লেখকরা উপস্থিত থাকেন।
সূত্র: ইন্টারনেট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে