দুর্নীতিবাজদের দেশত্যাগ নিশ্চিত হওয়ার পর কেন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়!
বাংলাদেশে দুর্নীতি হয়, এটা সবাই জানেন। এটা এখন এক সর্বগ্রাসী প্রবণতা। তবে এতদিন যেটা নিছক ধারণা ছিল, সেটা এখন প্রবল সত্য হয়ে সামনে এসেছে। বাংলাদেশে সব খাতেই কমবেশি দুর্নীতি হয়। যেখানে কম হয়, সেখানে দুর্নীতির সুযোগ কম; যেখানে বেশি হয়, সেখানে দুর্নীতির সুযোগ বেশি। পার্থক্য শুধু সুযোগের। কেউ যদি দাবি করেন, কোনো খাতে দুর্নীতি হয় না, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। সুযোগের অভাবে অনেকে সৎ। সেই সৎ মানুষটিকে কোনো দুর্নীতির জায়গায় পাঠিয়ে দেন, দেখবেন তিনিও সেই দুর্নীতির চক্রে মিশে গেছেন। এটা আসলে সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলে ভাববেন না, বাংলাদেশে সৎ মানুষ নেই।
সব খাতে দুর্নীতিবাজ যেমন আছে, সৎ মানুষও আছেন। সবাই দুর্নীতিবাজ হলে এই সমাজ এতদিন টিকে থাকত না। তবে সৎ মানুষের পক্ষে এই দুর্নীতির চক্রে টিকে থাকা মুশকিল। কিছু কিছু অফিস আছে, যেখানে ঘুষের রেট বাধা আছে। ব্যক্তি যেই হোক, রেট অনুযায়ী চেয়ারে চেয়ারে ঘুষের ভাগ পৌঁছে যাবে। এটা একটা দারুণ চেইন। এখন এই চেইনে যদি মাঝখানে কোনো সৎ মানুষ ঢুকে পড়েন, তাহলেই বাকিরা মুশকিলে পড়ে যান। একজন ঘুষের ভাগ নিতে না চাইলে পুরো সিস্টেমটাই ভেঙে পড়তে চাইবে।
তাই বাকিদের কাজ হলো দ্রুত সেই সৎ মানুষটিকে ঘুষচক্রে ঢুকিয়ে ফেলা, নইলে কোণঠাসা করতে করতে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলা, নইলে বদলি করিয়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া। বাংলাদেশে আসলে দুর্নীতি না করে টিকে থাকাই মুশকিল। থানা, পুলিশ, হাসপাতাল, বিআরটিএ, পাসপোর্ট, এনআইডি, জন্মসনদ, ভূমি অফিস- যেখানেই যান ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়বে না। আপনি যদি মনে করেন, ঘুষ ছাড়াই কাজ করাবেন, এই দেশে জন্মানোর জন্য নিজেকে অভিশাপ দেবেন। কদিন আগে একটি খবর নিয়ে ফেসবুকে খুব চর্চা হয়েছে।
আদনান ফেরদৌস নামে এক কামেল সরকারি চাকুরে তার চাকরি বদল করেছেন। বিসিএস তথ্য ক্যাডারের আদনান ফেরদৌস বাংলাদেশ বেতারের সহকারী বেতার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছিলেন; কিন্তু তিনি আরেক দফা চেষ্টায় নন-ক্যাডার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আদনান ফেরদৌস ক্যাডার পদ ছেড়ে নন-ক্যাডার পদে যোগ দিয়েছেন। এটা সবাই বুঝতে পারছেন, তার নতুন পদের সম্মান পুরোনো পদের চেয়ে অনেক কম, বেতন তো অবশ্যই কম। নতুন চেয়ারে বসে তার পুরোনো চেয়ারকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে। তারপরও তিনি কেন সম্মান, বেতনের পরোয়া না করে নিম্ন পদটাকেই বেছে নিলেন? কারণ নতুন পদে উপরি আয়ের সুযোগ অনেক বেশি।
আদনান ফেরদৌসকে দিয়ে ‘ছিলাম বোকা হইলাম বুদ্ধিমান’ এর নতুন ভার্সন বানানো সম্ভব। উপরি আয়ের আশায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদের মতো বিশেষায়িত একাডেমিক ক্যারিয়ারের লোকজনও বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ বা কাস্টমসে যোগ দিতে চান। বিসিএস ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা, তথ্য এসব ক্যাডারের চাহিদা নেই বললেই চলে। এই আদনান ফেরদৌসের স্বেচ্ছায় ক্যাডার থেকে নন-ক্যাডার বেছে নেয়া; সবাই বুঝছেন, এটা তিনি করেছেন ঘুষ খাওয়ার জন্য। বেতার প্রকৌশলীকে কেউ ঘুষ দেবেন না; কিন্তু সাব-রেজিস্ট্রারকে ঘুষ দেয়ার জন্য মানুষ লাইন দেবে। ঘুষ-দুর্নীতির একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়েছে।
মেয়ে বিয়ে দেয়ার সময় পাত্রীর বাবাও জানতে চান, ছেলের উপরি আয় আছে কি না। আসল সমস্যা এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতায়। সন্তান তার বাবাকে প্রশ্ন করে না, তুমি ৫০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে ৬০ হাজার টাকা বাসাভাড়া কোত্থেকে দাও? ক্যাডার থেকে নন-ক্যাডারে যাওয়ার কারণে আদনান ফেরদৌসের সামাজিক যে অবনমন, তিনি সেই সম্মান কিনে নেবেন দুর্নীতির টাকায়। সারাজীবন দুর্নীতি করে গ্রামে গিয়ে আপনি মসজিদ বানাবেন, মাদ্রাসা বানাবেন। সদকায়ে জারিয়ায় আপনার সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে।
দুর্নীতির এই সর্বগ্রাসী প্লাবন কেন? কারণ সবাই জেনে গেছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি করলে কিছু হয় না। দুর্নীতিতে অর্জিত সম্পদ আরামসে ভোগ করা যায়। দেশে না পারলে বিদেশে আয়েশ করা যায়। ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা মেরে দেয়া যায়, বিদেশে পাচার করা যায়, কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনা যায়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানানো যায়। এত সুবিধা থাকলে মানুষ দুর্নীতি করবে না কেন?
বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। এই কমিশনের কাজ হলো দুর্নীতি খুঁজে বের করে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা; কিন্তু গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কোনো দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করে দিলে দুর্নীতি দমন কমিশন সেই মরা সাপকে আচ্ছামতো পেটাতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আরেকটি কাজ হলো, সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষে তাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়া। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাকমতোই; কিন্তু একটি গণমাধ্যমে সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ঝামেলা লেগে গেছে। একে একে সব গণমাধ্যমেই বেনজীরের কুকীর্তি ফাঁস হতে থাকে। তোলপাড় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
আলোচিত সাংসদ ব্যারিস্টার সুমন দুদকে গিয়ে বেনজীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। দুদকের আবেদনে আদালত বেনজীরের সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আদেশ দেন। দুদক বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের তলব করে এবং দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তার আগেই উড়াল দিয়েছেন বেনজীর। এখন জানা যাচ্ছে, জমি সরাতে না পারলেও ফ্রিজ করার আগেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। ব্যাপারটা এমন নয়, দুর্নীতির খবর ফাঁস হওয়ার পরদিনই বেনজীর হাওয়া হয়ে গেছেন। তিনি বহাল তবিয়তে দেশেই ছিলেন। ফেসবুক লাইভে এসে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন; কিন্তু যখন দেখলেন, সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনই তিনি পালিয়েছেন। তার মানে তিনি পালানোর জন্য, ব্যাংক থেকে অর্থ সরানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন।
বেনজীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তিনি দেশ ছাড়ার পর। কেন জানি মনে হয়, বেনজীর ঠিকঠাক মতো বিদেশে নিজের প্রাসাদে পৌঁছেছেন, এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। শুধু বেনজীর নন, দুর্নীতিবাজদের নিরাপদে দেশ ছাড়ার আরও অনেক নজির আছে। ছেলের ছাগলকাণ্ডে বিপাকে পড়া এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানও আলোচনায় আসার পর মূলধারার গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। মতিউর রহমানের দেশত্যাগেও আদালনের নিষেধাজ্ঞা আছে; কিন্তু নিষেধাজ্ঞা আসার আগেই তিনি লাপাত্তা হয়ে গেছেন। এর আগে পি কে হালদারও হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে নিরাপদে পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ তাকে না পেলেও কলকাতা তাকে পেয়েছে। বেসিক ব্যাংককে ফোকলা বানানোর কালপ্রিটের নাম সবাই জানেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত সংসদে আব্দুল হাই বাচ্চুর কথা বলেছিলেন; কিন্তু দুদক তার নাগাল পায়নি।
সিনেমায় দেখি ভিলেনের বাড়িতে অভিযানের আগে পুলিশের কেউই সেই খবরটি গোপনে তাকে জানিয়ে দেন। পুলিশ আসার আগেই ভিলেন লাপাত্তা হয়ে যায়। আমাদের দুদকে বা পুলিশেও নিশ্চয়ই দুর্নীতিবাজদের লোকজন। তারা নিশ্চয়ই সময়মতো জানিয়ে দেয়, তাড়াতাড়ি পালাও, অভিযান আসছে। সিনেমার কথাই যখন এলো, সম্প্রতি আলোচনায় আরেকটি সিনেমার কথা বলি। বলিউডে সম্প্রতি ‘লাপাত্তা লেডিস’ নামে একটি সিনেমা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। সেই সিনেমায় ট্রেনে দুই লোকের স্ত্রী বদল হয়ে যায়। পর্দা থাকায় স্বামীরা নিজেদের স্ত্রীকে আলাদা করতে পারেননি।
মূলত নারী অধিকারের কথা বলা হয়েছে ‘লাপাত্তা লেডিসে’। তবে বাংলাদেশের কোনো পরিচালক যদি ‘লাপাত্তা দুর্নীতিবাজ’ নামে একটি সিনেমা বানান, তাহলে নিশ্চয়ই সেটি সুপারহিট হবে। দুর্নীতিবাজরা কীভাবে সম্পদ অর্জন করেন, কীভাবে বিপাকে পড়েন, কীভাবে খবর পেয়ে সময়মতো চেহারা আড়াল করে পালিয়ে যান; সবকিছুর বর্ণনা থাকলে দারুণ থ্রিলার হবে। এর মধ্যে প্রেম, বিয়ে, যৌনতা, পরকীয়া, দ্বিতীয় বিয়ে, সন্তানকে অস্বীকার করা- পরতে পরতে নানান টুইস্ট তো থাকবেই। লাপাত্তা দুর্নীতিবাজদের বাস্তবে না হলেও রুপালি পর্দায় দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে