Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

প্রতিবেশীর নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাংলাদেশ হাত বাড়াচ্ছে কেন?

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪

বিশ্ববাজারে সোলার ফটোভল্টিক প্যানেলের দাম কমতে কমতে প্রতি ওয়াট ১১ সেন্টে নেমে এসেছে। ইনভার্টার এবং কেন্দ্র নির্মাণে আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করলে ওয়াটপ্রতি খরচ পড়ছে ১৪ সেন্ট। এর সঙ্গে জমি কেনা আর সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো ব্যয় নেই। এ পরিস্থিতিতে দেশেই নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আশার আলো দেখাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ চেষ্টা করছে নেপাল, ভুটান এবং ভারত থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে দেশে আনতে; কিন্তু কেন? তাহলে বাংলাদেশ কি প্রতিবেশীদের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে! এমন প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সম্প্রতি নেপালের কাছ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে নেপালে নির্মাণাধীন একটি ভারতীয় কোম্পানি জিএমআরের কাছ থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে চায় বাংলাদেশ। জিএমআরের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তির বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হয়েছে; কিন্তু জিএমআরকে কয়েক দফা সিকিউরিটি ডিপোজিট দেয়ার জন্য তাগাদা দিলেও পিডিবির হিসাবে কোনো টাকা জমা পড়েনি। এ কারণে জিএমআরের সঙ্গে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের যে চুক্তি সেটি হয়নি। তবে জিএমআর নেপালে যে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে তা মূলত বাংলাদেশকে টার্গেট করেই নির্মাণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ চুক্তি আজ হোক আর কাল হোক হবেই; কিন্তু এই চুক্তি করা কি বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ? তাহলে কোন বিচারে এবং কেন?

নেপাল থেকে এখন যে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে, তার দাম পড়ছে সঞ্চালন ব্যয়সহ ৮ টাকার মতো। এর সঙ্গে নেপাল, ভারত এবং বাংলাদেশের কর যোগ করে দাম কত পড়বে তা এখনো নির্দিষ্ট করা হয়নি। দেশগুলো করের হার বছরে বছরে বৃদ্ধি করলে অথবা কমালে বিদ্যুতের দামের ওপর তার প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে এ দামটি আগামী ২০ বছরের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যাবে; কিন্তু এই ২০ বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমার সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি।

কীভাবে এই সম্ভাবনা বেশি, তা জানার জন্য খুব বেশি খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন নেই। যেসব কোম্পানি সোলার প্যানেল উৎপাদন করে সেই কোম্পানিগুলোর কয়েক বছর আগের প্যানেলের সঙ্গে বর্তমান প্যানেলের তফাৎ বিশ্লেষণ করাই যথেষ্ট। এখন ৬৭০ ওয়াটের প্যানেল পাওয়া যাচ্ছে। আগে যা ছিল ৩৯৫ ওয়াট কিংবা তারও কম। অর্থাৎ আগে একটি সোলার প্যানেল ৩৯৫ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করত এখন সেই একই প্যানেল ৬৭০ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। অর্থাৎ একই জায়গায় দ্বিগুণের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

আগে যেখানে এক মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সাড়ে তিন একর জমির প্রয়োজন হতো। এখন সেখানে দুই একর জমিতেই এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। অর্থাৎ অল্প জমিতেই বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ভারতে এক ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৩০ রুপি থেকে ২ দশমিক ৬০ রুপির মধ্যে রয়েছে। ভারত চেষ্টা করছে ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিদ্যুতের দাম ১ দশমিক ৯০ রুপিতে নামিয়ে আনতে। সেখানে বাংলাদেশে এখনো সৌর বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১০ টাকার ওপরে। টাকার বিনিময় হার বিবেচনা করলেও এই দাম অন্তত বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ কম। ভারত এই দাম নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করছে, বাংলাদশে দীর্ঘদিনেও তা রপ্ত করতে পারেনি।

ভারত এক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে যেসব কোম্পানিগুলো সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় তাদেরকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোনো সহায়তা করে না। বাংলাদেশে যারা সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে, তাদের অভিযোগ ভূমি সংস্থান এবং ভূমি উন্নয়ন ব্যয়বহুল হওয়াতে এখানে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে বিশ্বব্যাংক থেকে জামালপুরে ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে ৬ হাজার একর জমি চাওয়া হয়েছে। এখানের ভূমি উন্নয়ন এবং সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমেই দরপত্র আহ্বান করা হবে।

একটি কোম্পানি শুধু সেখানে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ বসাবে। এতে করে প্রকৃতপক্ষে কতটা দাম পড়ে, তা দেখা সম্ভব হবে। এখন সৌরবিদ্যুতে কোনো দরপত্র না থাকাতে কোম্পানিগুলো নিজেদের মতো দর দেয়। সুতারং বলা যায়, এ ধরনের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখলে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমবে। এই উৎপাদন খরচ এতটাই কম পড়বে যে, দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হবে। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন সৌরবিদ্যুৎতো সারা বছর গড়ে চার দশমিক ৯ ঘণ্টার বেশি পাওয়া যায় না। বাকি সময় তাহলে কি দিয়ে চলবে। তারা হয়তো জানেন না মরক্কোর মতো আফ্রিকার দেশও ৭০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, যার পুরো বিদ্যুৎ তারা ব্যাটারিতে সংরক্ষণ করছেন।

মেঘলা আকাশ কিংবা রাতেরবেলায় এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা সম্ভব। চীন এই দৌড়ে আরও এগিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি চীন যে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ব্যাটারিতে সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেন করা হচ্ছে কারণ সারা বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির আধার সংকুচিত হয়ে আসছে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রয়মূল্য শূন্য। তাহলে আমরা কেন প্রতিবেশী দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এত নজর দিচ্ছি। না কি আমরা তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছি। একটা কথা বিদ্যুৎ কেউ ফ্রি দেবে না। আমাদের ডলার দিয়েই কিনতে হবে। আর একবার এই চুক্তি করলে ডলারের সংস্থান কীভাবে হবে, তা নিয়ে আগেভাগে চিন্তা করা উচিত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ