Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

১৬ জুনই কেন সংবাদপত্রের ‘কালো দিবস’?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসময় সাংবাদিকতাও করেছেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি। তিনি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ষাটের দশক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির যে সংগ্রাম- সেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি যখন প্রায় একাই পাঞ্জাবি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সংবাদ জগতের কর্মীরাই ছিলেন তার অন্যতম প্রধান সহায়ক শক্তি। বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেফাক তখন এক অর্থে আওয়ামী লীগেরই মুখপত্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর মুখপত্র ছিল বলেও ভুল হবে না। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন একে অপরের পরিপূরক।

বস্তুত সারা জীবনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। অথচ সেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ যে, তিনি চারটি বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস বলছে, নানাবিধ সংকট, চাপ ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলার অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে দেশে ‘বাকশাল’ নামে একটি নতুন ধরনের সরকার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর পাঁচ মাসের মাথায় ওই বছরের ১৬ জুন চারটি পত্রিকা (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার ও বাংলাদেশ টাইমস) রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার। এ জন্য সাংবাদিকদের একটি অংশ ১৬ জুনকে ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ হিসেবে মনে করে। কেউ কেউ এই দিনটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানও করে থাকে। প্রশ্ন হলো, ১৬ জুনকে সংবাদপত্রের কালো দিবস বলা কতটা যৌক্তিক এবং এরপর গত অর্ধ শতাব্দীতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে কি আর কোনো ঘটনা ঘটেনি, যেগুলোকেও সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের জন্য কালো দিবস হিসেবে উল্লেখ করা যায়?

সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মূলত তখন ব্যাঙের ছাতার মতো সংবাদপত্রে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। তখন বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৭ শতাংশ। অথচ শত শত সংবাদপত্র বের হতো। বঙ্গবন্ধু এখানে একটি শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি সাংবাদিকদের দিয়েই একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন। এই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান। তাদের সুপারিশেই চারটি পত্রিকা রেখে অন্যগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। যদিও বঙ্গবন্ধু সরকার সাপ্তাহিক ও অন্যান্য মিলে আরও ১২২টি পত্রিকা রেখে দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু ৪টি প্রধান পত্রিকা বাদে যেগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সেগুলোর সাংবাদিকদের কেউ বেকার হননি। কেননা বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকার এমনও অনেক সাংবাদিক যারা পত্রিকা থেকে নিয়মিত বেতনও পেতেন না, তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে চাকরি পেয়েছেন। যাদের অনেকেই উপ-সচিব, সচিব অথবা সমমানের চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। (শাহ আলমগীর, বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম, পিআইবি/২০১৩, পৃ. ৩৪)।

এবার দেখা যাক বাংলাদেশের পরবর্তী ইতিহাস কী বলছে?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরদিন দেশের সব সংবাদপত্রের ওপর খন্দকার মোশতাক সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পত্রিকা থেকে জাতির পিতা দূরে থাক, ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিও হাওয়া হয়ে যায়। দেশের সংবাদপত্রের জন্য এটিও কি কালো দিবস নয়? সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের আমলে গণমাধ্যমের ওপর কী ধরনের চাপ ছিল; কোন খবর ছাপা যাবে, কোনটি ছাপা যাবে না, তা নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত যেসব প্রেসনোট ও প্রেস অ্যাডভাইস আসতো- সেগুলো কি দেশের গণমাধ্যমের জন্য অবমাননাকর ছিল না?

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে যে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো ক্ষমতায় ছিল, তাদের আমলেও কি দেশের গণমাধ্যম খুব স্বাধীন ছিল?

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসা সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কি পত্রিকার অফিসগুলোয় রাজনৈতিক নেতাদের কথিত জবানবন্দি সরবরাহ করে সেগুলো ছাপার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়নি? এগুলো কি সংবাদপত্রের জন্য কালো ঘটনা নয়?

২০০০ সালে দেশের সম্প্রচার মাধ্যমে একটি নতুন ঘটনা ঘটে। ওই বছর সম্প্রচারে আসে একুশে টেলিভিশন- যেটি ছিল দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্টরিয়াল চ্যানেল; কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার টেলিভিশন চ্যানেলটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। যদিও ২০০৫ সালে এটি সম্প্রচারে ফিরে আসার লাইসেন্স পায় এবং ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শুধু স্যাটেলাইট এবং কেবল টেলিভিশনে পুনরায় সম্প্রচার শুরু করে। অতএব, যেদিন একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, সেটি এই টেলিভিশন চ্যানেলই শুধু নয়, দেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির জন্যও কি কালো দিবস নয়।

দেশের সংবাদভিত্তিক প্রথম চ্যানেল সিএসবি নিউজ চালু হয়েছিল ২০০৭ সালের ২৪ মার্চ; কিন্তু তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর এই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়। চ্যানেল ওয়ান সম্প্রচারে এসেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি; কিন্তু ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকারের আমলে ২০১৩ সালের মে মাসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে ধর্মীয় গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির সংবাদ সরাসরি সম্প্রচার করার সময় বন্ধ করে দেয়া হয় দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার। এই চ্যানেলগুলো আর সম্প্রচারে আসেনি। বর্তমানে চালু থাকা সংবাদভিত্তিক চ্যানেল যমুনা টেলিভিশনও বন্ধ করে দেয়া হলেও সেটি পরবর্তীতে চালু হয়।

একটি টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা পত্রিকা অথবা অনলাইন পোর্টাল বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা বন্ধ করে দেয়ার অর্থ হলো ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সব সাংবাদিক ও কলাকুশলীর বেকার হয়ে যাওয়া। যারা বেকার হয়ে যান তাদের সবাই যে পরবর্তীতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে আগের পদ ও বেতনে যোগ দিতে পেরেছেন, তা নয়। অনেকে দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন। অনেকে হয়তো পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং যেসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেই দিনগুলোও কি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছে কালো দিবস নয়? বঙ্গবন্ধুর আমলে পত্রিকা বন্ধ হলেও অন্তত সেই পত্রিকার সাংবাদিকরা তো বেকার হননি। বরং সংবাদপত্রের চাকরি যাওয়ার পরে অনেকেই রাষ্ট্রীয় চাকরি পেয়েছেন।

প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিক রেহমানের সম্পাদনায় ২০০৬ সালের ৬ জুন বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক যায়যায়দিন; কিন্তু এক-এগারোর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই এই পত্রিকাটি বড় ধরনের সংকটে পড়ে। একসঙ্গে শতাধিক সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হন। ঈদের ছুটি শেষে কর্মীরা অফিসে এসে দেখেন পত্রিকার গেটে চাকরিচ্যুত কর্মীদের তালিকা টানানো। সুতরাং ওইদিনটিও কি যায়যায়দিনের ইতিহাসে একটি কালো দিবস নয়?

অনেক ঘটা করে প্রকাশিত হয়ে আরও একাধিক সংবাদপত্র হয় বন্ধ হয়ে গেছে, না হয় গণহারে সেই পত্রিকা থেকে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে অথবা মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থেকেছে। বকেয়া আদায়ে কর্মীদের রাজপথে নামতে হয়েছে। আদালতে যেতে হয়েছে। সুতরাং কালো দিবস বলে শুধু ১৯৭৫ সালের ১৬ জুনকে টার্গেট করার কোনো মানে নেই। বরং এরপরেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে আরও অনেক কালো দিবসের জন্ম হয়েছে। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন; রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও করপোরেট নানাবিধ চাপে দেশের গণমাধ্যম কতটা জনমানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছে- সেটি বিরাট প্রশ্ন। যদি না পারে তাহলে শুধু ১৬ জুনকে সংবাদপত্রের কালো দিবস বলে গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক সংকট আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই।

বলা হয়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কখনো কখনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় পক্ষের চেয়ে অরাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি পক্ষ অনেক বেশি শক্তিশালী। বিশেষ করে এখন গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও বড় বিজ্ঞাপনদাতা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোই গণমাধ্যমের গণমাধ্যম হয়ে ওঠার প্রধান অন্তরায়। করপোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে একদিকে গণমাধ্যম যেমন ওইসব প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রে পরিণত হচ্ছে, তেমনি ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যেহেতু নানাভাবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত এবং সরকারের কাছ থেকে নানারকম বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা ব্যবসা করে; কর ফাঁকি দেয়; টাকা পাচার করে। অতএব, সরকারও গণমাধ্যমকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে চায়। সরকার চায় গণমাধ্যম শুধু তার প্রশংসাই করবে। তার মানে গণমাধ্যমকে একদিনে সরকার তথা রাষ্ট্রীয় চাপ এবং অন্যদিকে মালিক ও করপোরেটর পুঁজির চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। তারওপর আছে তার পেশাদারির সংকট এবং চাকরির অনিশ্চয়তা। একদিকে চাকরির অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে অনিয়মিত বেতন কিংবা চাকরি হারিয়ে নতুন চাকরি জোগাড়ের চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা কীভাবে স্বাধীনভাবে, সাহসিকতার সঙ্গে নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবেন- সেটি বিরাট প্রশ্ন।

বঙ্গবন্ধুকে যেমন সাংবাদিকদেরই একটি অংশ ৪টি বাদে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, এই সময়ের বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের বিদ্যমান সংকটের জন্য সাংবাদিকদেরই একটি অংশের দায় কম নয়। তারা নিজেদের সরকার ও মালিকের আস্থাভাজন হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে রেখেছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটতে দিচ্ছেন না। সুতরাং ১৬ জুনকে সংবাদপত্রের কালো দিবস বলতে চাইলে বর্তমান বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিদ্যমান সংকটগুলো নিয়েও নির্মোহ আলোচনা করতে হবে। গত অর্ধ শতাব্দীতেও গণমাধ্যম কেন পেশাদার হয়ে উঠতে পারলো না; কাদের কারণে পারলো না- সেটিও খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ