কোটার আলোচনা শুধু সরকারি চাকরিতে কেন?
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দের (১৯১৭-১৯৯৫) বড় ছেলে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মাহমুদ হোসেন আকন্দকে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তার মতো কিছু বিশিষ্টজনকে রাজধানীতে বাড়ি উপহার দেয়ার উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধু সরকার। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে বড় এবং সৎ ও নীতিবান আইনজীবী হিসেবে সেই তালিকায় মোশাররফ হোসেন আকন্দও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেহেতু আকন্দ সাহেবের ছেলে শহীদ হয়েছেন, তাই তালিকাভুক্ত বাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর কোনো একটি বাড়ি যেন এই সন্তানহারা পিতাকে বরাদ্দ দেয়া হয়; কিন্তু মোশাররফ হোসেন আকন্দ বাড়িটা গ্রহণ করেননি।
বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি বাড়ির চেয়ে আমার কাছে আমার সন্তান অনেক বেশি মূল্যবান। সন্তানের বিনিময়ে আমি কোনো বাড়ি নিতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধে আমার মতো অসংখ্য বাবা তার সন্তানকে হারিয়েছেন। সবাইকে বাড়ি দেয়া সম্ভব হবে না।’ এই ঘটনাটি শুনেছি মোশাররফ হোসেন আকন্দের ছোট ছেলে মাসুদ আলম আকন্দের কাছে। সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা একটি বাড়ি কিংবা সন্তানের সরকারি চাকরির জন্য যুদ্ধে যাননি।’
এটি হচ্ছে মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠ হলো, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রের যে সম্মান প্রদর্শন করার কথা ছিল; ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দীর্ঘদিন সেটি অনুপস্থিত ছিল। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা থাকলেও বছরের পর বছর এই নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে বরং কোনো কোনো সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ের কারণে অনেকের চাকরি হয়নি, এমন অভিযোগও আছে। এই মুহূর্তে কোটাবিরোধী যে আন্দোলন চলছে- যেটি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে এবং যে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার, সেই একইরকমের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কেননা উচ্চ আদালত সরকারের ওই প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। এই ইস্যুতে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। যেমন:
১. সরকারি চাকরিতে কোটা বা বিশেষ সুবিধার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধান কী বলছে?
২. যেহেতু আদালত সরকারের প্রজ্ঞাপন অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন, অতএব এখন কি সরকারি চাকরিতে আগের মতোই ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল হবে? আপিল বিভাগের চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির আগে কি এ বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?
৩. যে যুক্তিতে ২০১৮ সালে ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, তার ফলে গত ছয় বছরে সব নিয়োগ কি মেধার ভিত্তিতে, অর্থাৎ কোনো ধরনের কোটার বাইরে সরকারি চাকরি হয়েছে?
৪. যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাদের জন্য কি সরকারি চাকরিতে কোটা থাকার প্রয়োজন নেই?
৫. মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ কত শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা যৌক্তিক?
৬. কত শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স আছে?
৭. মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্যও কোটা সংরক্ষণ করা কতটা যৌক্তিক?
৮. কোটা কি শুধু সরকারি চাকরিতে?
৯. বেসরকারি চাকরিতে কেন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা থাকবে না?
১০. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য শুধু সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থাই রাখতে হবে না কি শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে তাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যায়?
এবার উত্তর খোঁজা যাক:
সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। তবে নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেজন্য তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে। প্রশ্ন হলো ‘অনগ্রসর অংশ’ বলতে কাদেরকে বুঝায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের নাতি-নাতনিরা সমাজের অনগ্রসর অংশ কি না?
বস্তুত অনগ্রসর অংশ বলতে উপজাতি, দলিত বা সমাজের প্রান্তিক পেশার মানুষদের বুঝানো হয়। এই অনগ্রসর মানুষদের শুধু সরকারি চাকরি নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধার আওতায় আনা দরকার। পাহাড় ও সমতলে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের সাংবিধানিকভাবে উপজাতি বলা হয়, নানা কারণেই তারা অনগ্রসর। সুতরাং সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য কোটা থাকতে হবে। বরং এই কোটার অনুপাত বাড়ানো দরকার। আবার উপজাতিদের মধ্যে কোনো কোনো গোষ্ঠী অনেক বেশি অনগ্রসর। তাদের চিহ্নিত করে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষেরাও অনগ্রসর। সুতরাং তাদেরকেও বিশেষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা দরকার কি না বা দরকার হলেও সেটি কত শতাংশ? মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো মুক্তিযোদ্ধার বয়স যদি ১৫ বছরও হয়, তাহলে এখন তার বয়স ৬৮ বছর। তিনি যদি ২৫ বছর বয়সেও বিয়ে করেন, তারপরও তার কোনো সন্তান এখন আর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যোগ্য নন। কেউ যদি আরও কম বয়সে বিয়ে করেন, তারপরেও ৩২ বছরের নিচে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এখন পাওয়া যাবে না। সম্ভবত এই যুক্তিতেই তাদের নাতি-নাতনিদের এই কোটার আওতায় আনা হয়েছে। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকার পরেও বছরের পর বছর ধরে তাদের সন্তানরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পাননি এবং এতদিনে তাদের বয়স শেষ হয়ে গেছে।
অতএব, তাদের নাতি-নাতনিদের কোটার সুবিধা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ঋণ শোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু সরকারি চাকরি দিয়েই কি তাদের প্রতি ঋণ শোধ করতে হবে? আর কোনো উপায় নেই? কেননা এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। যেটি বর্তমান সরকারের একটি বিরাট প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বরং এই ভাতার পরিমাণ আরও ১০ হাজার টাকা বাড়ানো যায়। এটা ঠিক যে, অনেক মুক্তিযোদ্ধাই স্বচ্ছল। পক্ষান্তরে এখনো অনেক অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাদের খুঁজে বের করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা দরকার। সরকারি চাকরিতে তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা প্রয়োজন; কিন্তু সেটি কত শতাংশ? এটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
কোনোভাবেই এই কোটা ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য এবং উপজাতিসহ পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আরও ১০ শতাংশ কোটা রেখে বাকি ৮০ শতাংশ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া দরকার। তবে কোটা শুধু সরকারি চাকরিতে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য এবং সমাজের অনগ্রসর অংশের মানুষের জন্য বেসরকারি চাকরিতেও কোটা রাখা দরকার। সরকার চাইলে এটা বাধ্যতামূলক করতে পারে যে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই নিয়ম মানবে না তারা সরকারের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। চাকরির চেয়েও বড় কোটা থাকা দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য কোটা থাকে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৫ শতাংশ কোটা থাকা উচিত। অর্থাৎ চাকরি নয়, বরং চাকরি পাওয়ার উপযোগী করে রাষ্ট্র যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের যোগ্য করে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়, সেটি অনেক বড় কাজ হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য এবং অনগ্রসর অংশ বাদে অন্য সব কোটা, এমনকি নারী ও জেলা কোটাও উঠিয়ে দেয়া দরকার। কেননা নারীদের এখন আর অনগ্রসর অংশ বলার সুযোগ নেই। তারা এখন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন।
পাবলিক পরীক্ষা ও চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও তারা পুরুষের সঙ্গেই লড়াই করার মতো সক্ষমতা অর্জন করেছেন। সুতরাং এখন আর আলাদা করে নারী কোটার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন। সরকারি চাকরিতে জেলা কোটারও প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সরকারের পদায়নকৃত স্থানে গিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। কে কোন জেলার বাসিন্দা- সেটি বিবেচ্য হওয়ার কথা নয়। তবে ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক কারণে কোনো জেলা পিছিয়ে থাকলে সেই জেলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেটি অবশ্যই কোটা নয়।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও সঞ্চালক, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে