তাপদাহে পুড়ছে কেন যশোর-চুয়াডাঙ্গা
বাংলাদেশের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান ছিল নাটোরের লালপুর। তবে গত প্রায় এক যুগ ধরে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা। গত শনিবার এই জেলায় তাপমাত্রার পারদ উঠে ৪২ ডিগ্রির ওপরে। শুধু এ বছরই নয় গত এক যুগ ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে এই জেলায় তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রায়ই থাকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। বৈশাখ মাস এলেই খরতাপে পুড়তে শুরু করে চুয়াডাঙ্গা। দিনেরবেলায় যেন অনুভূত হয় মরুভূমির তাপ। শুধু চূয়াডাঙ্গাই নয়, এর পাশের জেলা যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও খুলনাও গ্রীষ্মে হয়ে ওঠে তাপদাহের হটস্পট।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের এই কয়েকটি জেলায় দেশের অন্য এলাকার থেকে কেন বেশি তাপমাত্রা থাকে? এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে- বাংলাদেশের মাঝ বরাবর অতিক্রম করেছে কর্কটক্রান্তি রেখা। সূর্য থেকে চুয়াডাঙ্গার অবস্থান বা সোলার পজিশন ঠিক এই কর্কটক্রান্তি রেখার নিচে। এর ঠিক পাশেই রয়েছে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোর, ঝিনাইদহ ও খুলনা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের এই এসব জেলায় সূর্যের উত্তরায়নের কারণে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বাড়ে। পৃথিবী সাড়ে ২৩ ডিগ্রি কোণে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ফলে ২১ মার্চের পর থেকে ২১ জুন পর্যন্ত উত্তর মেরুতে সবচেয়ে বেশি সূর্যের তাপ পৌঁছায়। আর বাংলাদেশ যেহেতু ২২ থেকে ২৬ ডিগ্রি এরকম অবস্থানে আছে এবং কেন্দ্র রয়েছে ২৩ ডিগ্রির কাছাকাছি। ফলে সূর্যের যে সর্বোচ্চ কিরণ সেটা পড়ে এই সব অঞ্চলে। যে কারণে এই অঞ্চলে তাপমাত্রাটা বেশি থাকে। আবার এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। যার কারণে সূর্যের তাপ বেশিই পরে এই অঞ্চলে।
আবার যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা অঞ্চলে রয়েছে বিস্তৃত সমভূমি। এ ছাড়া এই অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বিশাল এলাকাজুড়ে সমভূমি। ফলে তাপমাত্রা প্রবাহের যে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে- পরিবহন, পরিচালন এবং বিকীরণ- এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এই অঞ্চল দিয়ে পরিবহন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে।
অন্যদিকে, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা দিয়ে জলীয় বাষ্প প্রবেশ করায় তাপমাত্রা বাড়ে। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমঘাট হচ্ছে খুলনা, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল। আর বঙ্গোপসাগর হচ্ছে জলীয় বাষ্পের উৎস। বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে বলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অন্যান্য এলাকার তুলনায় এই এলাকায় বেশি থাকে। ফলে তাপমাত্রাও বেশি থাকে।
এ ছাড়া যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, মেহেরপুর ও খুলনা অঞ্চলের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড ও মধ্য প্রদেশ। ভারতের এসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র গরম বাতাস প্রবাহিত হয়ে সরাসরি এসে লাগে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এই বাতাস পরে রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট ও বরিশাল পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। তবে এসব অঞ্চলে প্রচুর জলাশয়, নদী ও গাছপালা থাকায় গরম তুলোনামূলক কম অনুভূত হয়। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে জলাশয় ও গাছপালা তুলনামূলক কম থাকায় তাপটা শোষণ হচ্ছে না। তাই গরমের তীব্রতা সেখানে বেশি।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে চুয়াডাঙ্গায় ২০১৪ সালের ২১ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এখন পর্যন্ত এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর পরের বছরগুলোতে একাধিকবার তাপমাত্রা ৪০-এর ঘর পার করেছে। চলতি বছর গত শনিবার ৪২ ডিগ্রি পার করেছে এখানকার তাপমাত্রা। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, ভারি বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাপমাত্রা রিলিজ হয় না। একটা অঞ্চলে যখন হিট ওয়েভ শুরু হয় তখন যদি এটা দ্রুত রিলিজ হতে না পারে তাহলে সেখানে গরম বেড়ে যায়। তাপ দ্রুত রিলিজ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, গাছপালা কমে যাওয়া, জলাধার কমে যাওয়া। যার সবই রয়েছে এই অঞ্চলে।
এ ছাড়া জেলাটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বর্তমানে এখানে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ভারতের বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও কলকাতা হিট ওয়েভ চলছে। ওখানে যখন তাপমাত্রা বেশি থাকে এখানেও বেশি থাকে। এর কারণ ভৌগোলিকভাবে যশোর-চুয়াডাঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি। পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা যখন বেশি থাকে এখানে তাপমাত্রা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর একটা হিট ওয়েভ যখন পশ্চিমবঙ্গ হয়ে প্রবেশ করে তার একটা অংশ যশোর-চুয়াডাঙ্গা হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করে এটাও অন্যতম কারণ। এ ছাড়া লু হওয়া ও অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি এই দুইয়ের যুগপৎ সংমিশ্রণে যশোর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গাসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চল এপ্রিল মাসে উত্তপ্ত থাকে। প্রায় একই অবস্থা থাকে মে মাসেও। তাই বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত ভোগান্তির চূড়ান্তটাই দেখতে হবে যশোর-চুয়াডাঙ্গাসহ পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীকে। এই অঞ্চলের এখনকার পরিস্থিতি যেন কবির কবিতার মতো। ‘সূর্যটা ছড়িয়ে দিচ্ছে আজ, অগ্নি বৃষ্টি; নিশ্চিহ্ন করে দেবে বুঝি, তামাম সৃষ্টি। খুলে গেছে হাবিয়া দোজখের দ্বার। পুরে যাচ্ছে সবকিছু, শুধু হাহাকার।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে