যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলেন কমলা হ্যারিস
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেন হারলেন কমলা হ্যারিস? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় ভোটের লড়াইয়ে জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ভাষণ থেকেই। তিনি বলেছেন,‘আই অ্যাম নট গোয়িং টু স্টার্ট ওয়ার, আই অ্যাম গোয়িং টু স্টপ দ্য ওয়ারস। ’ এর অর্থ ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কোনো যুদ্ধ চান না, বরং চলমান যুদ্ধগুলো থামাতে চান। নানা সমালোচনা, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রথম বাক্যটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে নয় বরং বিশ্ববাসীকেই দারুণ আশান্বিত করেছে। আর এটাও যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায়, গত চার বছর ধরে জো বাইডেনের যুদ্ধ বিস্তৃতির নীতিতে অতিষ্ঠ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। তাই তারা ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর প্রতি আর আস্থা রাখতে চাননি। আর এ কারণেই কপাল পুড়েছে কমলা হ্যারিসের। জয়ের মুকুট চলে গেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথায়। বাইডেনের ভুল নীতির কারণেই পপুলার ভোট, সিনেট আর কংগ্রেস- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট বিজয় পেয়েছেন রিপাবলিকানরা।
কভিড-১৯ মহামারিতে বিধ্বস্ত জনপদ যখন কেবল একটু একটু করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের দিকে জোর করে ঠেলে দিয়েছেন, পুরো বিশ্বকে অস্ত্রের বাজারে পরিণত করেছেন। ফলে বিরূপ প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নয়, বরং বিশ্বজুড়েই পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের কম-বেশি সব দেশকেই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বড় ধরনের আশঙ্কার ভেতরে পড়তে হয়েছে। মেয়াদের শেষের দিকে এসে বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার জন্য আবারও ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীকেই বেছে নিলেন। লাশের গন্ধে বাতাস আটকে গেল গাজায়, রক্তস্রোতে ভাসল আরব উপসাগরের লেবানন প্রান্ত। এর ফল হলো আরও খারাপ। বাইডেন শুধু নিজেকে নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিলেন।
আসলে শুধু অর্থনৈতিক অস্থিরতাই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ভীষণ ক্ষেপেছে অন্য আর একটি কারণে। কারণটি খুবই অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে; কিন্তু এটাই সত্য যে বাইডেনের যুদ্ধ বিলাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের দেশে দেশে অবাধ ভ্রমণের পথ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পূর্ব ইউরোপ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ কড়া সতর্কবার্তার মধ্যে পড়ে গেল। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা শুরু হওয়ার পর শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো এশিয়াতেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বাধীন বিচরণ সংকুচিত হয়ে গেল। ভ্রমণপিপাসু হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা এ ধরনের অবস্থা মেনে নিতে চায়নি। এখন ট্রাম্প ইউক্রেন এবং ইসরায়েল প্রশ্নে কি অবস্থান নেবেন কিংবা এ দুটি ক্ষেত্রে বাইডেন নীতির সঙ্গে ট্রাম্প নীতির দূরত্ব কতটা হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশের ভোটাররা আগের মেয়াদে ট্রাম্পের নীতি এবং গত চার বছরে বাইডেন নীতির গভীর পর্যবেক্ষণ ঠিকই করেছেন। ‘যুদ্ধ এবং অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণ’- বাইডেনের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বাইডেনের রানিং মেট কমলা হ্যারিসকে আস্থায় নেয়ার যুক্তি খুঁজে পাননি। কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের এটাই বড় কারণ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অদ্ভুত ধরনের মানুষ। বিশেষ করে বেফাঁস মন্তব্য, প্রতিপক্ষকে নির্দয় আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে তিনি বার বার সমালোচিত হয়েছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে না নিয়ে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করেছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে। এরপর ফৌজদারি অপরাধে সাজা পাওয়া, অনেক অঘটনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেন এবং নিজরবিহীন জয়ের রেকর্ড গড়লেন। এর মূল কারণটিই ছিল ট্রাম্পের আগের মেয়াদ। ওই মেয়াদে তিনি কোথাও যুদ্ধ সম্প্রসারিত হতে দেননি। বরং যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য তাকে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। এ কারণে যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা যায়, যুদ্ধবিরোধী বক্তব্যের কারণেই ট্রাম্প এবার যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এবং কর্তৃত্বে। রাশিয়া, চীন সেই কর্তৃত্বের বিপরীতে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের জায়গাটি এখনো নিতে পারেনি। এ কারণে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি মূলত বিশ্ব নেতৃত্বের আসনেই বসে যান। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নীতি এবং সিদ্ধান্তের প্রভাব কম-বেশি বিশ্বের সব দেশেই পড়ে। যেমন কভিড-১৯ এর পর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলোকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। আরও দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো চরম বিপাকে পড়ে যায়। ফলে বাইডেন বিশ্বব্যাপী চরম অজনপ্রিয় হয়ে পড়েন। ডেমোক্র্যাট নীতি নির্ধারকরা নিজের দেশের ভোটারদের মধ্যেও বাইডেনের অজনপ্রিয়তার বাস্তব চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন। এ কারণে তারা বাইডেনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কমলা হ্যারিসকে সামনে নিয়ে আসেন। হিসাবটা ছিল ক্যারিশম্যাটিক। কমলা ভোটারদের সামনে নতুন আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবেন এবং ভারতীয় অভিবাসী ভোটারদের সহজে ডেমোক্র্যাটদের দিকে রাখা যাবে; কিন্তু সে হিসাবটি এবার কাজে লাগেনি।
বরং এবার যুদ্ধবিরোধী নীতিই যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। যে কারণে নির্বাচিত হয়েই যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ঘোষণা বিশ্ববাসীকে আশান্বিত করেছে। বিশ্বে এত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সভ্যতার এত উৎকর্ষ সবকিছুকে বার বার ম্লান করে দিয়েছে দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা, অসহায় মানুষের আর্তনাদ। যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো উন্নয়নের ধারায় আসতে পারেনি। বরং অশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্র্য এখনো বিশ্বের অনেক দেশকে যোজন যোজন মাইল পিছিয়ে রেখেছে। আমরা আশা করি, ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবাজ, গণহত্যার সমর্থক দেশ নয়, বরং গণতন্ত্র, শান্তি, মানবাধিকার এবং ন্যায়ের পক্ষে অবিচল নেতৃত্বের দেশ হিসেবে তুলে ধরবেন।
রাশেদ মেহেদী: সাংবাদিক, সম্পাদক ভিউজ বাংলাদেশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে