সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অব্যাহতি কেন?
আমাদের প্রত্যাশা ছিল গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস, শিক্ষাঙ্গন পাব; কিন্তু হলো বিপরীত গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই শিক্ষাঙ্গনগুলো রাজনীতিতে ছেয়ে গেছে। রাজনীতি না বলে একে মব বলাই সঙ্গত- যেখানে কোনো বিচার-আচার নেই, সুষ্ঠু তদন্ত নেই; কোনো পক্ষ কারও বিরুদ্ধে লাগলেই নানা প্রতিবাদের মুখে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করে। গণ-অভ্যুত্থানের পর পর আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এই অভিযোগে অনেক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অধ্যক্ষ-উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে নতুন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু নিয়োগের সাত মাসের মাথায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)-এর উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ এবং উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এসকে শরীফুল আলমকে চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে তাদের বিরুদ্ধে কতিপয় শিক্ষার্থীর অভিযোগ, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্র-রাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক লোক আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৩ এপ্রিল বিকাল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। গত ১৪ এপ্রিল রাতে সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই ঘটনার জেরে গত রোববার উপাচার্যের পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগ না করায় গত সোমবার থেকে অনশন চালানোর ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
পুরো ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলে কয়েকটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই মাথায় আসে। এক. ছাত্র-রাজনীতি বন্ধের দাবিকে ঘিরে সংঘর্ষ হবে কেন? এটা তো একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত। দুই. শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলাবেন কেন? এটা কি জোরজবরদস্তির বিষয়? তিন. সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে ঢালাওভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কি এই সমস্যার সমাধান করা যেত না? কিংবা অন্য কোনো শাস্তি কি নির্ধারণ করা যেত না। সব দেখে মনে হচ্ছে, যে কোনো বিষয়ই একটা চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তার আগে আর কোনো ভাবনাচিন্তা নেই।
এর মধ্যে আমরা দেখলাম একদিকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করলে অপরদিকে শিক্ষকরা মানববন্ধন করেন। শিক্ষার্থীরা একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে শিক্ষক সমিতি পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শিক্ষকরা বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতিবাদও জানান। অর্থাৎ কোনো আলাপ-আলোচনার সুযোগ নেই। পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ মিছিলই যেন এর একমাত্র সমাধান।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত উপাচার্য পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন; কিন্তু গতকাল বিকেলনাগাদ উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শেখ শরীফুল আলম সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করেননি, পদত্যাগ সংক্রান্ত কোনো চিঠিও পাননি। অন্যদিকে সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের অব্যাহতির সিদ্ধান্তে ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) শিক্ষক সমিতি।
উপাচার্যের অপসারণের মধ্য দিয়ে একটি সমস্যার সমাধান হলেও, নতুন করে আরেকটি সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষকদের ক্লাসরুমে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হবে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হবে, সেটিও দেখার বিষয়।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সব শিক্ষাঙ্গনের অবস্থাই আসলে নাজুক। যে ভয়ানক রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল সেই রাজনীতির কালো ছায়াই যেন তাদের ঘিরে ধরেছে। এরপর কোন অভিযোগে কোন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি ওঠে তাও জানেন না কেউ। পরিস্থিতি তাই আগুন গরম। আমরা চাই এরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান হোক শিক্ষাঙ্গন থেকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুখোমুখি না হয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুক। রাজনীতির কালো ছায়া থেকে শিক্ষাঙ্গন মুক্তি পাক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে