Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন?

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ৯ মার্চ ২০২৪

ত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪; ঢাকার বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ জন। যারা আহত হয়েছেন, তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাই মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সাত তলাবিশিষ্ট এই ভবনের অধিকাংশ তলায় ছিল খাবারের দোকান, গ্যাস সিলিন্ডারে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। সব রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল সিঁড়িতে, সিলিন্ডারে আগুন ধরে যাওয়ায় লোকজন সিঁড়ি দিয়ে বের হতে পারেনি। নিচ তলার কফিশপে বিস্ফোরিত সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত। জীবন্ত মানুষগুলো এত বীভৎভাবে পুড়েছে যে, মরদেহ শনাক্ত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা স্বজনদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা নেয়া হয়েছে। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে নিচে পড়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। ঘটনাটি হৃদয় বিদারক ও দুঃখজনক; সারা দেশের মানুষ ঘটনার ভয়াবহতা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কমিটি রিপোর্ট দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুপারিশ দেয়; কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন করার কারও গরজ থাকে না, অবশ্য সুপারিশ বাস্তবায়নের সুযোগও কম। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঢল, দরিদ্র আর হতদরিদ্রের বেঁচে থাকার কষ্টদায়ক মহাসংগ্রামে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে করতে হচ্ছে ব্যবসা, ফুটপাতে গৃহহীনদের রয়েছে পলিথিন ঘেরা আস্তানা; রাস্তায় রয়েছে স্বল্পগতির রিকশা, ঠেলাগাড়ি; ১০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোর লাগে দুই ঘণ্টা, দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাওয়া ছাইভস্ম থেকে তারা উদ্ধার করে কেবল কিছু মরা মানুষ। আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না, রাস্তায় রাস্তায় ওয়াটার হাইড্রেন্ট তৈরি করার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। বেইলি রোডে আগুন লাগার পর ঢাকার অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সিলগালা করার অভিযান প্রতিদিন চলছে।

ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় শাবল চালাতে দেখা গেছে। অধিকাংশ ভবনে ব্যবসা করার অনুমতি থাকলেও রেস্তোরাঁ খোলার অনুমতি ছিল না। সবাই জানে রেস্তোরাঁ ব্যবসারই অংশ, অনুমতিপত্রে পার্থক্য টানা থাকলেও তা এতদিন কারও নজরে আসেনি কেন? রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন লাগে- রেস্তোরাঁর মালিকরা নতুন করে এই তথ্যটি জানতে পেরেছে। বাংলাদেশে কোনো কার্যক্রম শুরু করতে একাধিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। কারণ যত কর্তৃপক্ষ তত দুর্নীতি। রেস্তোরাঁগুলো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চলে, কথাটি বলেছেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। কথাটি তিনি গোপনে বলেননি, বলেছেন সংবাদ সম্মেলনে। জনগণ তার কথাটি বিশ্বাসও করে। জনগণ আরও বিশ্বাস করে যে, রাজউক, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসনের লোকজন নিয়মিত এসব অননুমোদিত রেস্তোরাঁয় বিনা পয়সায় আহার করেছে, খাবার বাসায় নিয়েছে। নিয়মকানুন বিবেচনা করা হলে ঢাকা শহরের প্রায় সব রেস্তোরাঁই সিলগালা করে দিতে হবে। কীভাবে অনুমোদন ছাড়া এত বিপুলসংখ্যক রেস্তোরাঁ গড়ে উঠল?

ঢাকা শহরে এখন বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কের মতো অসংখ্য শপিং সেন্টারে ফুড কর্নার রয়েছে এবং এসব ফুড কর্নারে সম্ভবত গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহৃত হয়, এসব শপিং সেন্টারে আগুন লাগলেও নিরাপদে লোকজন বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, সন্দেহ। তাই অনিয়মের কারণে সিলগালা করা হলে অসংখ্য লোক বেকার হয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যাবে, পাঁচতারা হোটেল ব্যতীত সাধারণ লোকজনের খাবার গ্রহণের কোনো রেস্তোরাঁ অবশিষ্ট থাকবে না। তাই বলে কি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা বহাল তবিয়তে থেকে যাবে? অবশ্যই নয়। প্রথমে ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, যারা এসব ক্ষেত্রে দেখভালের দায়িত্বে ছিল, যারা সরকারের বেতন নিয়েও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। শুধু রেস্তোরাঁ নয়, প্রতিনিয়ত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পরিবহন যাত্রীর মৃত্যু হচ্ছে, রান্নাঘরে গৃহিণীর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, পথচারী আহত হচ্ছে, কারখানার শ্রমিকের হাত উড়ে যাচ্ছে। গ্যাস নেওয়ার সময় প্রায়ই সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ হয়; নিম্নমানের সিলিন্ডার এসব দুর্ঘটনার জন্য কতটুকু দায়ী, তার পরিসংখ্যান জানা নেই।

রান্নাঘরে সিলিন্ডার সর্বদা আগুনের কাছে থাকে, আগুনের উত্তাপ যদি বিস্ফোরণের কারণ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রেও ব্যবহারকারীর প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা বাঞ্ছনীয়। বিশেষজ্ঞরা গ্যাসের লিকেজকে অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করে। এ ক্ষেত্রে গ্যাস ব্যবহারকারীর সচেতনা জরুরি ও অপরিহার্য। বহুতল কোনো ভবনে আগুন লাগলেই শুধু সবার মনে পড়ে যায়, ভবনটির নির্মাণে নীতিমালা মানা হয়নি। ভবন নির্মাণ নীতিমালা মানার গরজ আমাদের কারও নেই। ঢাকা শহরে নিরানব্বই শতাংশ ভবন বিল্ডিং কোড অনুসরণপূর্বক নির্মাণ করা হয়নি। নির্মাণ নীতিমালা না মানার পেছনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের ইন্ধন আছে। নীতিমালার বরখেলাপ না হলে দুর্নীতির উদ্ভব হয় না, দুর্নীতির উদ্ভব না হলে রাজউকের অসৎ কর্মচারী-কর্মকর্তারা ঘুষও পায় না; তাই অসৎ পরিদর্শকের পরামর্শেই ভবন নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটানো হয়। সবার ধারণা রাজউকের পরিদর্শন না থাকলে এত অনিয়ম হতো না। এটা সত্য, ঢাকা শহরে নির্মাণাধীন অসংখ্য ভবনের মনিটর করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল রাজউকের নেই, মনিটর করার জন্য তাই আলাদা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। ভবনে ফায়ার ফাইটিং সরঞ্জামাদি পর্যাপ্ত থাকলেও কাজে আসে না, বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে আগুন নেভানোর স্বয়ংক্রিয় সরঞ্জামাদি থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজে আসেনি। কোনো ভবনেই ফায়ার ফাইটিং সরঞ্জামাদি ব্যবহারের জন্য আলাদা লোক থাকে না, আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে থাকে, কেউ সরঞ্জামাদি নিয়ে আগুনের দিকে এগিয়ে যায় না।

অন্যদিকে এগুলোর ব্যবহার কলাকৌশল ভবনবাসী বা নাগরিকদের জানাও থাকে না। সচরাচর কোনো ভবনেই একাধিক সিঁড়ি থাকে না বিধায় সিঁড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে বেরোনোর আর কোনো উপায় থাকে না। ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম না থাকলে আগুন লাগার সংবাদ ভবনে অবস্থানকারী সবাই তাৎক্ষণিক জানতেও পারে না। অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী ভবন হলেই কেবল সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার অনুমোদিত অভিজ্ঞ প্রকৌশলী অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকেন। তাই ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের বহু বছর পর ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করার অভিযোগ তোলা অর্থহীন। এই কথাটি উচ্চারণ করেছেন এফবিসিসিআইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিন হেলালী।

বাংলাদেশে জবাবদিহি নেই, জবাবদিহি থাকলে যেসব অফিস অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হতো। আগুন লাগলেই ভবনের মালিককে গ্রেপ্তার করার জন্য খোঁজা হয়; কিন্তু খোঁজা হয় না রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে। সরকারের এমন নির্লিপ্ততা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপহাস করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, অপরাধী ধরা পড়ার পর জানা যায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণের অসংখ্য মামলা রয়েছে; দুর্ঘটনা ঘটার পর জানা যায় গাড়ির ফিটনেস বা ড্রাইভারের লাইসেন্স ছিল না; রোগীর মৃত্যুর পর উদ্ঘাটিত হয় চিকিৎসক ভুয়া; ক্ষমতাচ্যুত হলেই জানা যায় মন্ত্রী-আমলা দুর্নীতিবাজ; নির্মিত স্থাপনা উচ্ছেদকালীন জানা যায় নদীর পাড়ে সরকারের জায়গায় ১২ তলা ভবন নির্মিত হয়েছে; দল থেকে বহিষ্কারের পর জানা যায়, বহিষ্কৃত নেতা ছিল চোর-গুন্ডা-ডাকাত; আগুন লাগার পর জানা যায় বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এসব কথা জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

তাই দেশ পরিচালনায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের দায় এড়ানো যাবে না, দুর্নীতিবাজ ও নিষ্ক্রিয় লোকদের প্রশাসন থেকে সরিয়ে দেয়া জরুরি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দুদিন পরে সবাই সবকিছু ভুলে যাবে, আরেকটি ভবনে আগুন লেগে মানুষ মরলে আবার কয়েকদিনের জন্য সরকারি সংস্থাগুলো সক্রিয় হবে।

লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক এমডি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ