শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কেন কমিশন গঠন করা হয়নি!
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। কমিটিগুলো ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। অতীতে বেশ কয়েকটি কমিশন শিক্ষা খাতের সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন দাখিল করলেও কোনো সরকারই সেই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করেনি। ফলে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যুগের চাহিদা পূরণে সক্ষম হচ্ছে না। আমরা উচ্চ শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলছি। কিন্তু তারা কতটা সুশিক্ষিত এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এবং কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না হলে কোনো দিনই জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে জনশক্তি গড়ে তুলছে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করতে মোটেও সক্ষম নয়। এক সময় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে উপরের দিকে থাকতো। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার ওপর আগের মতো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিভা বিকাশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তেমন একটা অবদান রাখতে পারছে না। প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা খুবই অপ্রতুল। এই বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগই অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে ব্যয়িত হয়। শিক্ষা গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নতমানের গবেষক তৈরি করতে পারছি না।
ইউনেস্কোর মতে, একটি দেশের মোট জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। বরাদ্দকৃত এই অর্থের বেশিরভাগই গবেষণা কার্যে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে প্রতি বছর যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় তার পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও কম। যেহেতু শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের একটি বড় অংশই অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজে ব্যয়িত হয়। তাই গবেষণা কাজে অর্থ পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে। সামগ্রিক বলতে গেলে বলতে হয় শিক্ষার মান একেবারেই অবনতিশীল রয়েছে। শিক্ষার মান এতটাই অবনতি হয়েছে যে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ষাটের দশকে আমাদের এই অঞ্চলে শিক্ষার যে মান ছিল স্বাধীনতার পর তা ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা যেসব গ্র্যাজুয়েটস তৈরি করছি তারা কার্যত অর্ধ শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটস। এদের অধিকাংশকেই সুশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটস বলা যাবে না। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণ এবং জ্ঞানচর্চা বলতে আমরা যেটা বুঝি তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার এই নিম্নমান পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি অভিজ্ঞতার আলোকে এর দুটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছি।
প্রথমত, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় সিদ্ধান্ত ছিল বাংলায় উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হবে। বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করা এবং বিদেশি বই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য বাংলা একাডেমিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি সেই দায়িত্ব পালনে সফল হয়নি। আমরা যারা শিক্ষক-গবেষক তারাও চাহিদা পূরণের মতো প্রচুর পরিমাণে গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। ফলে শিক্ষার্থীদের বিদেশি ভাষায় লিখিত বই, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় লেখা বই পড়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারছে না। ফলে জ্ঞানের প্রবাহ যেভাবে বিস্তৃত হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। কারণ জ্ঞানার্জনের জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই।
বই থেকেই জ্ঞানার্জনের নানা উপকরণ পাওয়া সম্ভব। ক্লাসরুমে শিক্ষকের দেয়া বক্তব্য থেকেও জ্ঞানার্জন করা সম্ভব। তবে যে শিক্ষক ক্লাস নেবেন তার প্রস্তুতির জন্য বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই জ্ঞানার্জনে বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ গুণগত মানসম্পন্ন বই পাওয়া যায় না। আর বেশিরভাগ বই বিদেশি ভাষায় অর্থাৎ ইংরেজিতে লেখা বলে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে বই পড়ে তা সঠিকভাবে অনুধাবন করা সবসময় সম্ভব হয় না। অনেকেই পূর্ববর্তী ছাত্রদের কাছ থেকে প্রাপ্ত নোট মুখস্ত করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। এভাবে তো আর প্রকৃত জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হয় না। যদি বই পড়ে বুঝতে না পারে তাহলে জ্ঞান আহরণ করবে কোত্থেকে?
দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় যদি বিকল্প পথে জ্ঞান আহরণের ব্যবস্থা থাকতো অর্থাৎ বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বই পাওয়া যেত তাহলে শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারতো। বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা জ্ঞান আহরণের সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এ জন্যই মাতৃভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক বই থাকা জরুরি। কিন্তু আমরা সেই চাহিদা পূরণ করতে পারিনি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত নিম্নমানের। এদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন যার শিক্ষক হওয়ার মতো ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না। প্রধানত দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় এরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। অবশ্য সব শিক্ষকই যে একই শ্রেণির তা নয়। এদের মধ্যে কিছু ভালো শিক্ষক আছেন যারা নিয়মিত পড়াশুনা ও গবেষণা করেন। কিন্তু একটি বিরাটসংখ্যক শিক্ষক আছেন যাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অযোগ্য যেসব ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন তাদের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, তাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে মহল বিশেষের সন্তুষ্টি অর্জন করে চাকরি টিকিয়ে রাখা যায়।
শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় কোনোভাবেই দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া উচিত নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত সাড়ে ১৫ বছরে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মেধা এবং যোগ্যতার কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পর তারা জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে দলবাজি করেছেন। কীভাবে শাসক গোষ্ঠীকে তুষ্ট করা যায় সেই চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। সেই তিনি যদি দলবাজি করেন তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষকও আছেন যারা তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম দেখেও না দেখার ভান করেছেন। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস জেঁকে বসেছিল। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করেছে। দলবাজ শিক্ষক সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসকে আমলে নিয়ে তা দমনের কোনো ব্যবস্থা করেননি। কারণ তারা মনে করতেন, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাদের অবস্থান ঠিক থাকবে না। এই সুযোগ নিয়ে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের এক শ্রেণির নেতাকর্মী ব্যাপক চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়েন।
একজন শিক্ষক হিসেবে এটা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, আমরা শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারিনি। জাতির প্রত্যাশা মতো মানের শিক্ষা প্রদানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একজন শিক্ষক সর্বজনীন মর্যাদা প্রাপ্তির দাবিদার কিন্তু ব্যাপকভিত্তিক দলীয়করণ, চাটুকারিতা এবং দলবাজির কারণে শিক্ষকদের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। আগস্ট আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। একজন শিক্ষকের প্রতি এ ধরনের আচরণ মোটেও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষকের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের অসম্মান করেছে। তারপর একজন শিক্ষক হিসেবে আমি এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণের নিন্দা জানাই।
একজন শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তার আনুগত্য প্রদর্শন করা ঠিক নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোনো কোনো শিক্ষকের আচরণ দেখে মনে হয় তিনি শিক্ষক নন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একটা সময় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া হতো। তখন শিক্ষার মান এতটা নিম্নগামী ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হচ্ছেন উপাচার্য। এখন সেই সব শিক্ষককেই উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় যারা সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন। এমনও শোনা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য মহল বিশেষকে অর্থ দিতে হয়েছে। কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিকেই উপাচার্য নিয়োগ দেয়া উচিত যিনি একজন শিক্ষাবিদ, একজন গবেষক এবং সবসময় জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাহলে তিনিই শিক্ষার্থীদের চাহিদা বুঝতে পারবেন। তাদের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে পারবেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্য বলতে পারবেন। কিন্তু এসব না করে যিনি শুধু দলবাজি করেন তাকে উপাচার্য নিয়োগ দিলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করবেন?
গত সাড়ে ১৫ বছর দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কি সরকারকে বলেছেন দেশে গণতন্ত্র কায়েম করেন। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেন। তা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ সরকারের অযৌক্তিক প্রশংসায় নিয়োজিত থেকেছেন। সরকারপ্রধান যে ভাষায় কথা বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণও সেই একই ভাষায় কথা বলতেন। তাদের এই প্রশংসাসূচক বক্তব্য শ্রবণ করে সরকার মনে করতেন, তাদের মতো ভালো কাজ আর কেউ করতে পারেনি। তারাই উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু গণতন্ত্র, আইনের শাসন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে যে উন্নয়ন তা কখনোই প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে না। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমরা কি দেখেছি? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কেউ কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন কিন্তু তারপরও তারা ন্যায়ের পথচ্যুত হননি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের কথা শোনা যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগকে মোটেও সমর্থন করি না। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ভালো নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি বিক্রি হয়। অর্থ খরচ করলে সার্টিফিকেট কিনতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ভালো হলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাদের মালিকানায় গড়ে উঠেছে এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করেন। এতে উচ্চ শিক্ষার বাণিজ্যিকায়ন হয়েছে।
উচ্চবিত্ত শ্রেণির পরিবারের ছেলেমেয়েরাই মূলত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের অনেকেই মনে করেন, গার্মেন্টস শিল্প যেমন একটি প্রকল্প ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প বৈ আর কিছু নয়। অথচ মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৯২ সালে যে আইনের অধীনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই আইন ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সময়োপযোগী। সেই সময় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেত না। সেই সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলাম।
আমরা একটি শিক্ষক প্রতিনিধিদল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরি। আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে জানাই, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না আসন স্বল্পতার কারণে। অনেক শিক্ষার্থী দেশের কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এবং অন্যান্য দেশে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের বক্তব্য শুনে খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি বললেন, এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী লেখাপড়ার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে এটা রোধ করার জন্য আপনারা আরও বেশি বেশি করে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করেন। আমরা তাকে জানাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা সীমিত রাখতে হবে। আমরা তাকে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাই। আমাদের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেশ আগ্রহ প্রদর্শন করলেন।
পরবর্তীতে এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা জাতীয় সংসদে পাস করার ব্যবস্থা করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আইন পাস হওয়ার পর ৪/৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বেসরকারি উদ্যোগে। এগুলো বেশ ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়ার ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই সুযোগে এমন সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যাদের লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি করতে শুরু করে।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে