বিশ্ববিদ্যালয় দাবি কর্মসূচিতে জনগণের ভোগান্তি কেন
দেশে বর্তমানে ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত সাতটি কলেজকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করছেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের এই দাবি কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রায় প্রতিদিন সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে জড়ো হয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেসব এলাকাসহ আশপাশের সব সড়কে দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ গত সোমবার (১৮ নভেম্বর) সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালানোর সময় মহাখালী রেলগেট অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। তখন তারা একটি চলন্ত ট্রেনকে লক্ষ্য করে পাথর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করায় শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়েছে। এই ঘটনায় আহত ও রক্তাক্তদের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।
পরে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায়ভার রেল কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না বলেও মনে করেন তারা। আমরা এর আগে ঢাকা কলেজের ছাত্রদেরও এরকম উচ্ছৃঙ্খল কার্যক্রম দেখেছি। তাদের দাবির যৌক্তিকতা থাকতে পারে; কিন্তু সেটা তো সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রাণলয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়। এর জন্য এমন যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির অবতারণা কেন?
এখন যদি দেশের অন্যান্য কলেজও বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে এরকম অবরোধ-বিক্ষোভ শুরু করে তাহলে কী অবস্থা হবে? কলেজ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ই রূপান্তর করতে হয়, তাহলে কলেজই-বা থাকার দরকার কী আর স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালই বা থাকার দরকার কী? এ কথা সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটি তাৎপর্য আছে।
বাংলাদেশের অনেক কলেজ থেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠদান করা হয়, এগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অত্যন্ত করুণ। তা ছাড়া যেসব পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন দেশে বর্তমান তার বেশির ভাগেরই শিক্ষাব্যবস্থা তত ভালো নয়, নানাভাবেই সেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভূমি নেই, ক্যাম্পাস নেই। নামে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়; কিন্তু কার্যক্রম চলে কলেজের শ্রেণিকক্ষে।
মোট কথা দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই এক ভয়ংকর অরাজকতার মধ্যে নিহিত। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নৈরাজ্য বদলানো নিয়ে কোনো সামগ্রিক কথাবার্তা তেমন নেই। আছে শুধু নিজস্ব দাবি-দাওয়া। তাতেও যে অবস্থা খুব বদলাবে এমন নজির ও রূপরেখাও এখনো কোথাও থেকে আশ্বাস পাওয়া যায়নি। রূপরেখার পরিবর্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এক ধরনের জোর-জবরদস্তি; কিন্তু শিক্ষা কি জোর-জবরদস্তির বিষয়?
সর্বশেষ জানা যাচ্ছে যে, তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব কি না, খতিয়ে দেখতে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা।
দেখা যাচ্ছে এর সঙ্গে কেবল ছাত্র ও উপদেষ্টারাই জড়িত, কোনো শিক্ষা-গবেষক নেই, শিক্ষাবিদ নেই। তার মানে কি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকারেরও কোনো রূপরেখা নেই, শিক্ষাবিদদেরও কোনো গবেষণা নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নায়ন না করে আরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কী ফল হবে? তা ছাড়া সব কিছুই কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকতে হবে? এত কাজের চাপ, এত বিষয়, লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে তারা কীভাবে সামলাবে।
শিক্ষার্থীদের তুলনায় দেশে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অপ্রতুল, আরও কম বিষয়ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বড় ধরনের রূপরেখা ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও সরকার তিন পক্ষকেই এখানে যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে তৎপরত হতে হবে। এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করতে হবে। শুধু দাবি ও জোর-জবরদস্তিতে কোনো সমাধান হবে না।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার এসব দাবি আদায় করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী সাধারণ জনগণের চক্ষুশূল হচ্ছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের যেন কোনোভাবে অপরাধী বানানো না হয়। একটি কথা মনে রাখতে হবে, তারা পরিস্থিতির শিকার। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এটা দেশের অরাজক শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এটা হয়েছে। এ জন্য নির্দিষ্ট কাউকে দায়ী না করে বর্তমান সরকারকে শিক্ষাব্যবস্থা আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে