Views Bangladesh Logo

সব দলীয় সরকারই অন্য সরকারের অবদানকে কেন অস্বীকার করে?

জুলাই এবং আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিজয়ে বড় ভাগ বসাতে চায় বিএনপি; জামায়াতে ইসলামও চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা জামায়াতকে স্বীকৃতি দিলেও বিএনপিকে বেশি কৃতিত্ব দিতে আগ্রহী নয়। তাই দুপক্ষের মধ্যে মাঝে মাঝে বাকযুদ্ধ হয়। বিএনপি মনে করে তারা পনেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে, তাদের সংগ্রাম অব্যাহত না থাকলে শুধু জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন সম্ভব হতো না। কথাটি মিথ্যা নয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়ার ফলে ১৬ ডিসেম্বরে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।

এই ১০ দিনের যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকেই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, পুলিশ, বিডিআর, বাঙালি সেনা এবং সর্বস্তরের জনতা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। পূর্ব বাংলার মানুষের হাতে অস্ত্র ছিল না, দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে ছিল না কোনো যোগাযোগ, তখন ইন্টারনেট সমৃদ্ধ মোবাইলও ছিল না, ছিল না কোনো নেতৃত্বও। পরবর্তী ৯ মাস দেশের সর্বত্র গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে, গেরিলাদের ভয়ে পাকিস্তানি সেনারা মৃত্য ভয়ে আতঙ্কিত থাকত। ৯ মাসের গেরিলা যুদ্ধ না হলে যৌথ বাহিনী ১০ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় এভাবে নিশ্চিত করতে পারত না। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে বিএনপির অবদানের কথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মানা উচিত।

দিব্য চোখে বিচার করলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের যুক্তিও অকাট্য। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিএনপির ১৫ বছরের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়নি, হয়েছে ছাত্রদের আন্দোলনে। ছাত্রদের কথা স্পষ্ট, বাড়ির সম্মুখে বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা একটি ট্রাকও বিএনপি সরাতে পারেনি, তারা সরকার পতন করবে কী করে! কথাটি ব্যাঙ্গার্থক হলেও একেবারে অসত্য নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম না হলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন বিএনপির আন্দোলনে হতো না; কিন্তু বিএনপি মনে করে তাদের দলীয় কর্মীরা জীবন দিয়েছে বেশি। বিএনপি এক্ষেত্রে একটু স্ববিরোধী।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য যদি তাদের ১৫ বছর সংগ্রামের অবদান মুখ্য হয় তাহলে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের সংগ্রাম ও আত্মাহুতির ইতিহাসের মূল্যায়নও হওয়া উচিত। ৬ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বাংলাদেশের জন্য আলাদা পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, ডামি বন্দুকে ছাত্র-জনতার সামরিক প্রশিক্ষণ, ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে পুলিশ-বিডিআরের যুদ্ধ- এসব ঘটনা হয়েছে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার আগে।

চট্টগ্রামের যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অংশগ্রহণের আগেই বাঙালি সেনারা যুদ্ধ শুরু করেছিল। ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়’ বইতে তখনকার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন চট্টগ্রাম অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন তখনো জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেছেন, পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের ব্যবস্থা করতে যাওয়ার সময় পথিমধ্য থেকে তাকে ফেরত আনা হয়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কলাকৌশলীদের অনুরোধে জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে সম্মত হন। এই ঘোষণার আগে সাধারণ জনগণের নিকট জিয়াউর রহমান একেবারেই অপরিচিত ছিলেন, কেউ তার নামও শোনেনি। পরে তিনি সেক্টর কমাণ্ডার হন এবং বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালি সেনা, বিডিআর ও পুলিশের অসংখ্য রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে সংঘটিত হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। তবে ১ মার্চ থেকেই সমগ্র বাংলাদেশে চলতে থাকে দুর্বার আন্দোলন; কিন্তু বিএনপি পেছনের ঘটনাগুলোর কথা বলে না, বলে শুধু ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক’। স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বের আন্দোলন-সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের সামান্যতম সংশ্লিষ্টতাও ছিল না। সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলেই বিএনপি শুধু স্বাধীনতা ঘোষণার কৃতিত্ব নিতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও একই নীতিতে বিএনপির পেছনের পনের বছরের আন্দোলন-সংগ্রামকে গুরুত্ব না দিয়ে ৫ আগস্টের নতুন ‘ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর।

আগের ইতিহাস সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ না করে শুধু স্বাধীনতা ঘোষণাকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করার জন্য শুধু বিএনপি দায়ী নয়, আওয়ামী লীগও দায়ী। আওয়ামী লীগও জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে বেমালুম মুছে ফেলতে চায়। জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বিএনপি শুধু সেই ঘোষণাকেই স্বীকার করে। কিন্তু পরমুহূর্তে তিনি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পুনরায় আরেকবার স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন তা বিএনপি ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করে না। অবশ্য আওয়ামী লীগও জিয়াউর রহমানের এই অবদানকে স্বীকৃতি দেয়নি।

আওয়ামী লীগের কাছে একমাত্র স্বীকৃত ঘোষণা হচ্ছে ২৬ মার্চে বিডিআরের ওয়্যারলেসে দেয়া বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত স্বাধীনতা ঘোষণা। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা পাকিস্তানি সেনাদের ওয়্যারলেসের বেতার তরঙ্গে ধরা পড়েছিল; পাকিস্তানি সেনাদের বেতার তরঙ্গে ধরা পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানি সেনা সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে। পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। একটি কথা অনস্বীকার্য যে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হয়ে দিলেও সেই সংকটময় মুহূর্তে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা দিশেহারা বাঙালি সেনা ও জনতাকে পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশে কেউ কারও অবদান স্বীকার করে না। শেখ হাসিনা শুধু তার পরিবারের সদস্যদের আত্মত্যাগের কথা বারবার বলতেন, মানুষ শুনতে শুনতে এত বিরক্ত হয়ে পড়েছিল যে, টিভিতে তাকে আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও এড়িয়ে চলত, তার বক্তব্য শুনত না। এক বছরব্যাপী বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে নানাবিধ অনুষ্ঠান দেশের বেশিভাগ লোককে আবেগায়িত করেনি, এমন কী আওয়ামী লীগের সচেতন কর্মী-সমর্থকরাও অনুষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেনি। লেবু বেশি কচলানো হলে তিতা হয়ে যায়- এই বোধশক্তি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছিল না।

আইয়ুব খানবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে মাওলানা ভাসানীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার আন্দোলনেও তার অবদান ছিল অপরিসীম। রাজনীতি নিয়ে মতাভেদ থাকলেও মাওলানা ভাসানীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অকৃত্রিম, বঙ্গবন্ধু তাকে পা ধরে সালাম করতেন; কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে মাওলানা ভাসানীকে কোন মূল্যায়ন করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের প্রবাসী অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমেদ ও তার সহকর্মীদের অবদান ইতিহাসের অত্যুজ্জ্বল অংশ; কিন্তু স্মরণ করা হয়েছে শুধু মৃত্যু দিবসে। তবে এটা সত্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মহাকাব্যিক সংগ্রামে কাউকে বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য ভাবার বাতুলতা কারও থাকলে তা পরিত্যজ্য।

দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও অস্বীকৃতির নীতি অনুসৃত হচ্ছে, কেউ কারো ক্ষমতায় আরোহনকে স্বীকার করে না, কেউ কারও উন্নয়ন কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করে না। কেউ মনে রাখে না যে, গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ সরকারসহ চারটি সরকারের পতন হয়েছে, পতনের আন্দোলনে সব সরকারকেই স্বৈরশাসক বলা হয়েছে, সব সরকারকেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্বৈরশাসক হলেও সব সরকারের আমলেই কমবেশি দেশের উন্নয়ন হয়েছে। আইয়ুব খান তার উন্নয়ন নিয়ে ‘উন্নয়নের দশক’ উদযাপন করেছেন; কিন্তু উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা-পরবর্তী কোনো সরকার কখনো স্বীকার করেনি। সব দলীয় সরকারই অন্য সরকারের সব উন্নয়নকে অস্বীকার করে শুধু নিজেদের উন্নয়নের ফিরিস্তি গেয়েছে।

নিজেদের উন্নয়নকে গৌরবান্বিত করতে গিয়ে অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারকে হেয় করেছে, শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারও ২০০১ সনে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারে কুকীর্তির ফিরিস্তি দিয়ে জনগণকে নিজেদের পক্ষে টানার কৌশল শুরুতে ফলপ্রসূ হলেও পরে তার তাৎপর্য ফিকে হয়ে যায়। কারণ যারা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তাদের কর্মকাণ্ডেও একই কুকীর্তির বন্যা বয়ে যায়। তাই বোধ হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের জোরালো উচ্চারণ, এক স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়ে আরেক স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তারা প্রাণ দেয়নি, এক দুর্নীতিবাজ সরকারকে হটিয়ে আরেক দুর্নীতিবাজ সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ছাত্ররা অকাতরে প্রাণোৎসর্গ করেনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা জড়িত না থাকলেও বর্তমান চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের সব দায় বর্তাচ্ছে কিন্তু তাদের ওপর। এটাই রাজনৈতিক কৌশল, পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া। তাই দেশের পরিবর্তন আনতে হলে ড.ইউনূস সরকারকে আরও সতর্ক এবং কৌশলী হতে হবে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: কলামিস্ট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ