রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংস্কার না করে কেন রাষ্ট্রের সংস্কার চায়?
রাজনীতি আমাদের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। আর চোখে কাপড় বেঁধে আমরা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করি রাজনীতিকে। এই পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল একটি মায়া বা ম্যাজিকের মতো। যার কুয়াশা-টানেল আমাদের চোখের ব্যাপ্তিকে কমিয়ে দিয়েছে। দিনে দিনে আরও কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষ সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা ‘সিস্টেম’ ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর ক্রমেই কমে আসছে। যদিও এটাই স্বাভাবিক! যাচাই করে বাজার করলেও সামাজিক জীবনে, পারিপার্শ্বিকতায় যাচাই করতে ভুলে গেছি আমরা। দু-চারটি ব্যতিক্রম সব সময় থাকে। তাদের চেঁচিয়ে ওঠাকে আমরাই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি; কিন্তু স্বপ্নেও তাদের পরিস্থিতির মুখোমুখি ভাবতে চাই না নিজেদের।
তাই তো সংকটও আমাদের পথ ছাড়ে না। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও দেশের সংবিধান, রাজনীতি, আইন নিয়ে আমাদের নতুন করে মাথা ঘামাতে হয়। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে সংস্কারের দাবি তুলতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবিড় ও ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন সম্পর্কে বিভিন্ন মহল বহুকাল ধরেই আলাপ-আলোচনা চলছে; কিন্তু বাস্তবে তা কোনো কাজে আসেনি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনসহ অনেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা উল্লেখ করেন সেগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যান্য শক্তির মধ্যে শ্রমিক সমাজ, আমলাতন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মনোযোগের দাবি রাখে। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও গণতান্ত্রিক, আরও বেশি সময়োপযোগী হওয়াটা যুগেরই দাবি। সেই দাবিকে অস্বীকার করে কোনো স্থিতিশীল কল্যাণকর ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণের সুযোগ রয়েছে। প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিমত থাকলেও দেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য রাজনৈতিক দলের ভেতরে সংস্কার ও গণতন্ত্রায়নের দাবি বর্তমানে জোরদার হয়ে উঠেছে; কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিবর্তন বা সংস্কারের তেমন কোনো তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। আর রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা নিজেদের সংস্কার না করে, তাহলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। আরোপিত বা চাপিয়ে দেয়া সংস্কার যে তেমন কোনো কাজে আসে না, তার প্রমাণ ২০০৭ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের ভূমিকা। সেই সময় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দলগুলোতে কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন আনা যায়নি।
সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানো। তা না হলে দেশে গণতন্ত্রচর্চা সম্ভব হবে না। দেশকে পরিবর্তন করতে হলে সবার আগে প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে। বলতে হবে, দলগুলো কী চায়, কীভাবে তা অর্জন করতে চায়। বিএনপি যেমন বলেছে, পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব থাকল না কেন? সব কিছুতেই একটা নিয়ম বেঁধে দেয়া দরকার। নেতৃত্বে আসীন হওয়া এবং রাজনীতি থেকে অবসরেরও একটা বয়স থাকা দরকার। চাকরি থেকে অবসরের যদি বয়স থাকে, তাহলে রাজনীতিতে নয় কেন?
একই মুখকে বছরের পর বছর না রেখে নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। এ জন্য পরিবারতন্ত্রকেও আঘাত করতে হবে। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি এলাকায় মাত্র কয়েকটি পরিবার নেতৃত্ব ভোগ করে। তারাই নির্বাচনে অংশ নেয়। বারবার ঘুরেফিরে এই মুখগুলোই নির্বাচিত হয়। এই ধারা অবশ্যই বদলাতে হবে।
আমাদের দেশে বড় দল বলি আর ছোট দল বলি- সবই এক ব্যক্তি ও এক পরিবারকেন্দ্রিক। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের বিধান নেই বললেই চলে। দলের শীর্ষ নেতানেত্রীরাই ঠিক করে দেন কমিটিতে কারা থাকবে। নেতৃত্ব বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। তা না হলে বংশাণুক্রমিক নেতৃত্বের ধারা থেকে বের হওয়া যাবে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেসব ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার ব্যবহার করে তার একদিকে থাকে দলের নেতানেত্রীদের বড় বড় ছবি। এর মানে হচ্ছে সেটা নেতার দল, সাধারণ মানুষের দল নয়। এই সংস্কৃতিতে তো পরিবর্তন আনতে হবে। এখানে একটা কথা বলা ভালো, পরিবারতন্ত্র মাত্রই খারাপ নয়। কারণ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা একটি পরিবারের আশ্রয় থেকেই আসে। এটি দোষের কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অযোগ্য লোক পরিবারের পারিবারিক সম্পর্কে রাজনীতিতে আসেন এবং পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় যা তার প্রাপ্য নয়, তা পান। তাহলে বলা যায় সেটিই পরিবারতন্ত্রের একটি নিকৃষ্ট নমুনা।
আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশে এরকম পরিবারতন্ত্র চলছে কি না। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতন্ত্র থাকে এবং যদি দলের সদস্যদের গোপন ভোটে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়, তাহলে পরিবারতন্ত্রের অবসান ঘটবে; কিন্তু যদি দলের সাধারণ সদস্য কিংবা কাউন্সিলররা বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো পারিবারিক সদস্যকে গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করেন, তখন তাকে পরিবারতন্ত্র বলা যাবে না। একটি সুষ্ঠু পরিবারতন্ত্রবিহীন পরিশীলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভেতর শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবারতন্ত্রের মতো এমন ক্ষতিকর ও নেতিবাচক ব্যবস্থার কবল থেকে রেহাই পাবে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারতন্ত্রের নেতিবাচক দিকগুলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পরিবারতন্ত্রের ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা ও উদার মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি সুষম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিযুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের সব মেধা ও শক্তি যদি কাজে লাগান, তাহলে বাংলাদেশের সমাজজীবনে অবশ্যই বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত হবে। এই দেশটির ভাগ্য যেহেতু প্রধানত রাজনৈতিক নেতারাই অনেকাংশে নির্ধারণ করবেন, কাজেই তাদেরই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরাই তো ভেবে এসেছি যে, পৃথিবীটা একটা ঘর। আমরা কোথাও না কোথাও জুড়ে আছি প্রত্যেকে, একে অপরের সঙ্গে। আমরা একটি যৌথ পরিবার। কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে যৌথ যাপনে এক থালায় ভাত খাবার স্বপ্নও দেখছেন হয়তো আমাদেরই কেউ কেউ। মানে, সবাই মিলে বাঁচা। এই সুন্দর পৃথিবীতে স্বল্প আয়ুর জীবন নিয়ে এসে ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ির ওপর হইহই করে বেঁচে থাকা একটি জীবনের মাঝে যে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছি আমরাই, তা তো দেয়া উচিত সন্ত্রাসবাদের দিকে। অনৈতিকতার দিকে। সব অন্যায় অপরাধের দিকে। কু ও কুটিলতার দিকে। তা হলে কেন তা উড়ে আসছে আমাদের বন্ধুর দিকে, আমাদের দিকে? থুতু উপরে তাকিয়ে ছুড়তে নেই, আমরা জানি। এতে নিজের গায়ে এসে লাগে। তারপরও আমরা এই অভ্যাস ছাড়তে পারছি না। আর এর ফলে, হয়তো এই প্রবণতার জন্য খানিকটা হলেও রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণনীতি বদলে যাচ্ছে। উন্নয়নের আগে উঠে আসছে উন্মাদনা।
আমাদের দেশে কয়েক ডজন রাজনৈতিক দল আছে। তারাও এগিয়ে এলে শান্তির বাতাবরণে যুক্তির বিরোধিতায়, চিন্তার বিরোধিতায় গণতান্ত্রিক লড়াই হবে; কিন্তু আমরা সহজেই ভোটকে যুদ্ধ বানিয়ে দিয়েছি। এই যুদ্ধে আমরা জয় ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারি না। ফলে নির্বাচনে পরাজয় কেউ মানে না। পরাজিত দল ও প্রার্থী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। এতে করে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তেই থাকে। এক পর্যায়ে তা পর্যবসিত হয় শত্রুতা হিংসায়। এই ধারা থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে শুভচিন্তার উন্মেষের মধ্য দিয়ে যদি বন্ধুত্বের, সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় থাকে, তবেই সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেয়া সম্ভব।
আসলে, বহুদিন আয়নার মুখোমুখি হতে পারছি না। মুখোমুখি হলেই উঠে আসে আত্মশ্লেষ প্রশ্ন, যার উত্তর সোজাসাপ্টা কিছু নেই, তবু আছে সূত্র। তা ধরে এগিয়ে গেলে বোঝা যায়, আত্মতুষ্টি পেরিয়ে নিজেকে বারবার আঘাত দিয়েই নিজেকে বা নিজেদের বদলানো সম্ভব। প্রত্যেকে যদি নিজেকে বদলাতে চান শান্তির জন্য, তবেই সম্ভব বদল। চিন্তা চেতনার বদল। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরও যদি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার বা বদলের পথে অগ্রসর না হয়, সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও সেই পুরোনো অসুখের শিকার হয়, তাহলে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের কোনো শেষ থাকবে না।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে