ঈদের ছুটিতে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কেন?
এবারের ঈদে সরকারি ছুটি ছিল ৯ দিন। এই ৯ দিনে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৫০-এর অধিক মানুষের। আহত হয়েছেন শতাধিক। এসব নির্মম দুর্ঘটনাগুলোকে মহামারির সঙ্গে তুলনা করা যায়। এগুলোকে শুধু দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে না দিয়ে হত্যাকাণ্ড বলাই শ্রেয়। একটা দেশের সড়ক কতখানি অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীন হলে মাত্র ৯ দিনে ৫০ জনের অধিক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়!
গতকাল শনিবার (৫ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঈদের আগের দিন ৩০ মার্চ থেকেই প্রলয়ংকরী দুর্ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অটোরিকশায় বাসের ধাক্কা খেয়ে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেল খাদে পড়ে, দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে পড়ে, পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এরকম বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পোকামাকড়ের মতো মানুষ মারা গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশায়।
এর আগেও বিভিন্ন ঈদের মৌসুমে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। অটোরিকশার দুর্ঘটনার খবরও প্রায়ই আসে সংবাদমাধ্যমে। মহাসড়কে বা ব্যস্ত সড়কে অটোরিকশা বন্ধের কথাও অনেকবার শোনা গেছে; কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। গত নভেম্বর মাসে ঢাকা মহানগরের মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণার প্রতিবাদে রাজধানীর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন অটোরিকশাচালকরা।
অটোরিকশা বন্ধের কথা প্রায়ই শোনা গেলেও মোটরসাইকেল বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা কখনো শোনা যায়নি। এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছেই। জ্যাম এড়াতে বা দ্রুত পৌঁছানোর তাগিদে আজকাল অনেকেই মোটরসাইকেল কিনেন। এসব মোটরসাইকেলের চালকরা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ, অনেক সময় কিশোরদেরও দলবেঁধে প্রতিযোগিতা দিয়ে মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়। এসব দ্রুতগতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল চালানোর মতো সড়ক বাংলাদেশে আছে কি না তাও কেউ হিসেব করে দেখে না। বাংলাদেশে সম্ভবত এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যার কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা আত্মীয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তরুণরা মোটরসাইকেল চালায় খুবই বেপরোয়া গতিতে। মোটরসাইকেল যেন বাংলাদেশে এক আত্মহত্যার ফাঁদ।
কেন এত অল্প সময়ে এত ব্যাপক প্রাণহানি ঘটল সড়কে তার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে ঘুরেফিরে এসেছে আগের জানাশোনা কারণগুলোই। এক কথায় বলা যায় চালকদের বেপরোয়া গতির কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কেন সড়কে ছিল না? হাইওয়ে পুলিশ বলছে, ঈদের আগে থেকেই তারা সড়ক নিরাপত্তায় প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাহলে কোথায় সেই নিরাপত্তা?
এর দোষ কাকে দেয়া যেতে পারে? চালককে না কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে? বাংলাদেশ যে চরম এক বিশৃঙ্খল দেশ তা বোঝা যায় সড়কের নৈরাজ্য দেখলেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কয়েকবার দেশ ফুঁসে উঠলেও আজও সেই ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অদক্ষ চালকের হাতে যাচ্ছে গাড়ির স্টিয়ারিং। সড়ক নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে নেই কাঠামোগত প্রতিষ্ঠান বা দপ্তর-সংস্থা। মহাসড়কে থামানো যায়নি ইজিবাইক, থ্রি-হুইলার, নসিমন-করিমনের মতো ছোট ছোট বাহন। অপেক্ষাকৃত সরু সড়কে যানবাহনের আধিক্য, বিপজ্জনক সড়ক-বাঁক চিহ্নিত না করা, প্রয়োজনমতো গতিরোধকের অভাব তো রয়েছেই। এসব কারণে ঈদের ছুটিতে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা সড়ক-মহাসড়কে বেদনাদায়ক মৃত্যুর মিছিল দেখল দেশ।
আমরা আর এই মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না। আমরা চাই যে করেই হোক সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করা হোক। তার জন্য সরকারকে অবশ্যই আরও কঠিন-কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে আরও সচেতন নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে