Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

তিতাসের হিসাবে এত গোঁজামিল কেন

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪

তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি সিস্টেম লস ২৩ ভাগ থেকে ৮ ভাগে নামিয়ে এনেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি ১৪ ভাগ সিস্টেম লস কমিয়েছে। অর্থাৎ ১৪ ভাগ গ্যাস সাশ্রয় হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দাখিল করা এক বিবরণীতে তিতাস দাবি করেছে তাদের সিস্টেম লস ২ থেকে ৫ ভাগ। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিতাস এই সিস্টেম লস পেল কোথায়? না কি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য তিতাস গোঁজামিলের হিসাব দাখিল করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সিস্টেম লস হ্রাসের সাফল্যের প্রচার করেন বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। এই জনেন্দ্র নাথ সরকার দাবি করেন তিতাস ২০২২ সাল থেকে নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে এই সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, তাদের লক্ষ্য সিস্টেম লস শূন্যে নামিয়ে আনা। বিদ্যুৎ তারের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের সময় বিদ্যুতের নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চালন ক্ষতি এবং বিতরণ ক্ষতি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে নির্দিষ্ট এই পরিমাণের বেশি হলে তা আসলেই চুরি বলে ধরে নেয়া হয়; কিন্তু গ্যাস প্রবাহিত হয় পাইপলাইনের মাধ্যমে। পাইপলাইনের বাইরে বের হলেই গ্যাসের বিল হওয়ার কথা। যদি কোনো কারণে সেটি না হয়, তাহলেই তা চুরি। এই চুরি জায়েজ করার নামই হচ্ছে সিস্টেম লস। এখন তিতাস যদি প্রতিদিন ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিক্রি করে, তাহলে ২৩ শতাংশ হারে ৪১৪ মিলিয়ন ঘনফুট সিস্টেম লস হয়। সাধারণ হিসেবেই এই চুরি পুকুর চুরি না সাগর চুরি। আর এটি সম্ভব হয়েছে তিতাসের হিসাবে গোঁজামিলের জন্যই।

২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি তিতাস বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে দাম বৃদ্ধির আবেদনের সঙ্গে সিস্টেম লসের যে হিসাব দিয়েছিল তাতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৭ হাজার ৫৭২ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কিনেছে। ওই একই বছর তারা গ্যাস বিক্রি করেছে ১৬ হাজার ৫৬৭ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ সিস্টেম লস হয়েছে ৫ দশমিক ৭২ ভাগ। তিতাসের ওই সময়ের পরিচালক (অর্থ) মো. ইসমাইল মিয়া এবং হিসাব শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. হুমায়ূন কবির স্বাক্ষর করে এই নিরীক্ষিত হিসাব দিয়েছেন কমিশনে। এ হিসাব বিবরণীতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বেলায় বলা হয়েছে, ওই বছর তাদের সিস্টেম লস ছিল ২ দশমিক ০১ ভাগ। ওই বছর তিতাস ১৫ হাজার ৪১৭ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রি করে ১৫ হাজার ১০৭ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট। এর পরের বছর ২০২০-২১-এ তিতাস ১৬ হাজার ১৮২ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ক্রয়ের বিপরীতে ১৫ হাজার ৮৫৮ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ঘনফুট বিক্রি করেছে। অর্থাৎ সেখানেও তারা বলছে তাদের ২ দশমিক ০১ ভাগ সিস্টেম লস হয়েছে। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬ হাজার ১২৮ মিলিয়ন ঘনফুট ক্রয়ের বিপরীতে ১৫ হাজার ৮০৫ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট বিক্রি হয়েছে অর্থাৎ সিস্টেম লস হয়েছে ২ ভাগ। কমিশনে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে হিসাব দাখিল করা হয়েছে। তখন অর্থবছর শেষ না হওয়াতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের একটি আনুমানিক সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে, যার পরিমাণ ২ দশমিক ২১ ভাগ। তিতাস তখন দাবি করে তারা ১৮ হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ক্রয়ের বিপরীতে ১৮ হাজার ২৩২ দশমিক ০৬ মিলিয়ন ঘনফুট বিক্রি করতে পারবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ২৩ ভাগ সিস্টেম লসের বিপরীতে তিতাস ২ ভাগ দেখিয়ে সমন্বয় করত কীভাবে। আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের হয়ে গেছে, তা আসলে কাদের পকেটে গেছে। এই টাকা কি কোনো দিন আর ফেরত আসবে, না কি ফেরত আনা সম্ভব! রাষ্ট্রীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানি লোকসান করলে রাষ্ট্র ভর্তুকি দেয়। কিন্তু তিতাস এত বছর ধরে কোনো লোকসানও করেনি। উল্টো তারা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ দিয়েছে।

এবার তাহলে আমরা হিসাবের গোঁজামিলটা বোঝার চেষ্টা করি। এক দিকে চুরি হচ্ছে। এই চুরিকে তারা সিস্টেম লস বলছে। আবার প্রকৃত যে সিস্টেম লস হচ্ছে তা না দেখিয়ে অনেক কম দেখানো হচ্ছে। এরপর মুনাফা হচ্ছে। তাহলে প্রকৃত গ্যাস ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কি পরিমান বাড়তি বিল আদায় করা হচ্ছে তা বোঝার জন্য ভালো অঙ্ক বোঝার দরকার আছে বলে মনে হয় না।

শেষ করি নিজের এক অভিজ্ঞতা দিয়ে। অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘ট্রুথ কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনে দুর্নীতিবাজরা যেতেন তাদের নাম পরিচয় গোপন করতে। তারা ট্রুথ কমিশনের সামনে স্বীকার করতেন কালো টাকার বিষয়ে। এরপর দুর্নীতির টাকার একটি অংশ সরকারকে দিয়ে দিতেন। এভাবে তারা মুক্তি পেতো। তখন তাদের নামধাম অন্যসব কিছু গোপন রাখা হতো; কিন্তু একটা সময় পর এসব আর গোপন রাখা যায়নি। এদের নামধাম, সম্পদের পরিমাণ বের করে আনলো সাংবাদিকরা। তখন জানা গেল কে কে ট্রুথ কমিশনে গিয়েছিল।

তিতাসের একজন ড্রাইভারকে নিয়ে সেসময় একটি পত্রিকা খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই ড্রাইভার নাকি শত কোটি টাকার মালিক। এবার তিনি তিতাসের সাবেক একজন তথ্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে হাজির। বললেন, স্যার আমি এই খবরের একটি প্রতিবাদ দিতে চাই। এখানে লেখা হয়েছে আমি শত কোটি টাকার মালিক। বিষয়টি আসলে সঠিক নয়। আমি ৮০ কোটি টাকার মালিক। বিষয়টি আমি ট্রুথ কমিশনে গিয়েও স্বীকার করে এসেছি। ড্রাইভার সাহেব প্রতিবাদ দেবেন তো দেবেনই। তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা তাকে বোঝালেন, না এসব প্রতিবাদের দরকার নেই। আপনি বরং কয়েক দিন সহ্য করুন। তাহলে এক সময় সব কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তিনি বিষয়টি বুঝলেন এবং পত্রিকা অফিসে প্রতিবাদ লিপি পাঠানো থেকে বিরত থাকলেন। এখন বিষয়টি হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানের গাড়ির চালক ৮০ কোটির মালিক। সেই প্রতিষ্ঠানের অন্যরা কী? আর এই গ্যাস চুরি টাকা আসলেই কোথায় যায়!

কিন্তু রাষ্ট্র কি অনুসন্ধান করবে তিতাস কেন ২৩ ভাগ সিস্টেম লসে থেকে ২ ভাগ সিস্টেম লস দেখিয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করলো? না কি তারা অবিরতভাবে হিসাবে এ ধরনের গোঁজামিলের দিতেই থাকবে এবং যথারীতি এদের কেউ কিছু বলবে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ