Views Bangladesh Logo

বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস

ক্রীড়া সাংবাদিক থেকে গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন হওয়া কঠিন কেন?

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

কোনো এক আলাপচারিতায় ২০০৭ সালে শফিক রেহমানকে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই; আমি কিন্তু একসময় ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলাম।’ যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক সম্পাদকের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অধ্যায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়নি। এটুকু জানা যায়, বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে গণমাধ্যমের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নেই। দেশ রূপান্তরের সম্পাদক মোস্তফা মামুন একসময় তুখোড় ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলেন। মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমানের ক্রীড়া সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কেও বিভিন্ন সময় জানা গেছে। ক্রীড়া সাংবাদিকতার সিঁড়ি বেয়ে সম্পাদক হওয়ার এমন নজির বর্তমান সময়ে আদৌ আর আছে কি না- সে তথ্যও জানা নেই। বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবস উপলক্ষে জানার চেষ্টা করা হয়েছে- সাবএডিটর কিংবা বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক রিপোর্টারদের তুলনায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন হওয়ার হার কেন কম?

বিভিন্ন ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে আলোচনা করে জানার চেষ্টা করা হয়েছে- পেশা হিসেবে এদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হতে পারল। এ প্রসঙ্গে পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও- সব জায়গায় বিচরণ করা জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মণ্ডল বলছিলেন, ‘কামরুজ্জামান, এ বি এম মূসা, ওয়াহিদুল হক, এনায়েতুল্লাহ খানের মতো প্রখ্যাত সাংবাদিকরা কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকেই নিজেদের বিস্তৃত করেছেন। কালের বিবর্তনে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতার মান বাড়েনি। হয়তো এ কারণেই এখন ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে আসার উদাহরণ খুব বেশি সৃষ্টি হচ্ছে না।’

অঘোর মণ্ডল মনে করেন নতুন শতাব্দীতে এসে ক্রীড়া সাংবাদিকতার মান পড়ে গেছে। তার কথায়, ‘খেলা রেখে খেলোয়াড়দের পেছনে ছোটার কারণে এমনটা হতে পারে। একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে সাংবাদিকতার সব শাখা সম্পর্কেই জ্ঞান রাখতে হয়। ক্রীড়াঙ্গনে ফিক্সিংয়ের মতো অপরাধের কারণে ক্রাইম রিপোর্টারদের মতো জ্ঞান থাকতে হয়। ডোপ পাপের মতো ঘটনার জন্য মেডিকেল বিটের রিপোর্টারদের মতো জ্ঞান থাকতে হয়। এ ছাড়া ক্রীড়া বাণিজ্য, ব্র্যান্ডিং-মার্কেটিং সংক্রান্ত কাজের জন্য বিজনেস রিপোর্টারদের মতো জ্ঞান রাখতে হয়। সাংবাদিকতার বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান রাখতে হলে পড়াশোনার বিকল্প নেই। অতীতের তুলনায় এখনকার সাংবাদিকদের পড়াশোনার প্রবণতা অনেক কমে গেছে।’

একসময়ের ক্রীড়া সাংবাদিক জিয়াউদ্দিন সাইমুম এখন ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে নানা গণমাধ্যমে কাজ করছেন। পেশা হিসেবে এদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পেশা হিসেবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা মোটেও প্রতিষ্ঠিত নয়। এটাকে আবেগের জোরে পেশা বলা হচ্ছে। সংগত কারণে ক্রীড়া সাংবাদিকতাও এই দেশে প্রতিষ্ঠিত পেশা হয়ে উঠতে পারেনি।’ বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসপিএ) সদস্য হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত জিয়াউদ্দিন সাইমুম আরও বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক স্কেল অনুযায়ী বেতন পান; কিন্তু সংসদে দেশবাসীকে শোনানো হয়: ৮৮টি সংবাদমাধ্যমে নবম বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, সাংবাদিকরা বাস্তবতা জানার পরও এই মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারেন না।’

সাংবাদিকরা বিভিন্ন সেক্টরের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য খুঁজে বের করে আনেন। নিজ কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত অনিয়মের শিকার হওয়ার চিত্র আড়ালে রেখেই চলে তাদের এ অনুসন্ধানী কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকরাও ব্যতিক্রম নন। দেশের হাতেগোনা দু-একটি গণমাধ্যম ছাড়া সর্বত্র একই চিত্র বিরাজ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের বেতন-ভাতার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থার সমন্বয় নেই। বিষয়গুলো শ্রম আইনেরও পরিপন্থি। এ অসামঞ্জস্যকে গণমাধ্যমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নানা উৎস থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার মতো কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বলা বাহুল্য, দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মতো সাংবাদিকতাও দূষণে আক্রান্ত। এ-সংক্রান্ত কোনো সমীক্ষা নেই বলে প্রকৃত চিত্রটা বোঝানো কঠিন; কিন্তু সাংবাদিকতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বেশ নেতিবাচক।

কেউ কেউ বলছেন দেশের অন্যান্য সেক্টরের চেয়ে সাংবাদিকতায় দূষণের মাত্রাটা বরং বেশি! ইউটিউব এবং নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক সাংবাদিকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে এসবের ওপর নিয়ন্ত্রণও নেই। স্মার্ট মোবাইলের সঙ্গে মাইক্রোফোন নিয়ে অনেকে সাংবাদিক হিসেবে মাঠে নেমে পড়ছেন। সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খোদ কিছু গণমাধ্যমই তাদের কর্মীদের নানা অনিয়মের পথে ঠেলে দেন- এমন অভিযোগ পুরোনো। সাংবাদিকদের একটা অংশ বিভিন্ন সেক্টরে নানা অনিয়ম করছেন- এমন চিত্র বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে এসেছে, এখনো আসছে। নিজস্ব কর্মীদের করা এ অনৈতিক কাজের সুযোগও না কি নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। একদিকে অনিয়ম, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ নেয়ার প্রবণতা- সমঝোতার ভিত্তিতে চলছে গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মী। এ বিষয়গুলো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে বাধার দেয়াল তুলছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

একসময়কার ক্রীড়া সাংবাদিক আশীষ চক্রবর্তী দেশের শীর্ষস্থানীয় নানা গণমাধ্যমে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে কর্মরত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? প্রশ্নের জবাবে আশীষ চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করার সময় থেকেই মনে হচ্ছিল এ পেশা দীর্ঘদিন নিরাপত্তা দেবে না। এ কারণে আমি ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নিজেকে আবদ্ধ রাখিনি। সাংবাদিকতার অন্যান্য শাখায়ও নিজেকে যুক্ত করেছি। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জার্মানিতে এসে কাজ করছি।’ আশীষ চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘দেশে এখন গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, সাংবাদিকতার প্রতিটি শাখা কিন্তু সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তাও বাড়েনি। এ অবস্থায় ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে মোটেও প্রতিষ্ঠিত বলা যাবে না।’ সাংবাদিকদের জীবনকে অনেকটা চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো উল্লেখ করে আশীষ চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘এখন ক্রীড়া সাংবাদিকদের গ্ল্যামার আছে। কিছু ক্ষেত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাজ দেখে অনেকে বাহবা দেন; কিন্তু বাস্তবজীবনে তাদের অনেকের কিন্তু না খেয়ে মরার উপক্রম হয়! তাদের অবস্থা অনেকটা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রানী সরকারের মতো! বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি বলতে পারব না- বাংলাদেশের ১০ শতাংশ ক্রীড়া সাংবাদিকের মাস শেষে পারিশ্রমিক পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। এ অবস্থাকে তো আমি প্রতিষ্ঠিত বলতে পারি না।’

১৯২৪ সালের ২ জুলাই ফ্রান্সে বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবসের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতা দিবস পালন করা হচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয় বটে। এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমের তেমন বিস্তৃতি নেই। দেশে ক্রীড়া সাংবাদিকদের তিনটি সংগঠন রয়েছে। যার একটি হচ্ছে বিএসপিএ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থার (এআইপিএস) সদস্যভুক্ত এ সংগঠন বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস পালনে সামান্য কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়। কেক কেটে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। তার বাইরে ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস পালনের অংশ হিসেবে প্রতি বছর দেশের একাধিক সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিককে সম্মাননা প্রদান করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে পেশা হিসেবে ক্রীড়া সাংবাদিকতা কতটা নিরাপদ বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?- জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসজেএ) সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টারের সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক আনিসুর রহমানের কাছে। উত্তরে অভিজ্ঞ এ ক্রীড়া সাংবাদিক বলেছেন, ‘সাংবাদিকতার একটা বিট বা শাখা হচ্ছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময় কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল না। ফলে ফুল টাইম সাংবাদিকের পরিবর্তে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পার্টটাইম কর্মী দিয়েই ক্রীড়াঙ্গনের খবরা-খবর তুলে ধরার কাজ করত; কিন্তু কালক্রমে গণমাধ্যম সম্প্রসারিত হয়েছে।

খেলাধুলার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি বেড়েছে। পাঠকের চাহিদার সঙ্গে বেড়েছে রেভিনিউ। আলাদা বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। সেই বিবেচনায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা অন্যান্য শাখার মতো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ হয়েছে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্রীড়া সাংবাদিকতার মানদণ্ড, কাজের সুযোগ, যথাযথ পারিশ্রমিকসহ আরও কিছু বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে।’ আনিসুর রহমানের কথাতে পরিষ্কার, ক্রীড়া সাংবাদিকতা একটি গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়েছে বটে; কিন্তু পেশা হিসেবে এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ