অর্থ পাচার
জরিপের ওপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ যে কারণে পূর্ণাঙ্গ নয়
সমাজ বাস্তবতায় বিভিন্ন ধরনের সূত্র বা থিয়োরি আবিষ্কৃত হয়। প্রতিটি থিয়োরি সব দেশ, সব কালের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য হয় না। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সূত্র বা থিয়োরি পরিবর্তিত বা পরিমার্জিত হয়। এমন কি কোনো কোনো সূত্র পরিত্যজ্যও হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কোনো তত্ত্বই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া বিবেচনা করা যায় না। হয়তো কোনো এক সময় একটি সূত্র বা থিয়োরি সর্বাধিক বাস্তব মনে হতে পারে; কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তা অপাঙক্তেয় হয়ে পড়তে পারে। এটা বাস্তবতা; কিন্তু আমরা প্রায়শই ভেবে থাকি, একটি তথ্য সর্বকালীন এবং সর্বজনীন। এ ছাড়া কোনো তত্ত্বকে বিচার করার সময় তার ব্যতিক্রমী চরিত্র নানাভাবে উপেক্ষিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে যেসব জরিপের ওপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ নয়। তাই সেখানেও সমস্যা থেকে যায়। কোনো তথ্যকেই পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বোতভাবে প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্য মনে করতে পারি না।
একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত দুবছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে ৭৮ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। এর মধ্যে ৩৪ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র হয়েছে। আরও ৯৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ দরিদ্রসীমার ঠিক উপরে বাস করছে, এরা যে কোনো সময় সামান্য আঘাতেই দরিদ্রসীমার নিচে নেমে আসবে। কয়েক বছর আগে করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে অন্য একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছিল, করোনার কারণে মানুষ শহর থেকে গ্রামমুখী অভিবাসন করেছে। অনেকেই পেশাচ্যুত হয়েছেন। এসব নানা কারণে ৩ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। পরবর্তী সময়ে এ মানুষগুলোর কী হয়েছে, তা আমরা জানতে পারিনি। এটা অর্ধ বা অসম্পূর্ণ গবেষণা বলা যেতে পারে। কারণ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নয়। বরং সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তারা কি করেছেন এবং কতটা সফল হয়েছেন, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন হলো, এই যে জরিপ প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং প্রকাশ করা হলো, তার ভিত্তি কী? জরিপকারীরা কি প্রতিটি ব্যক্তির পরিবারে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন নাকি নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যদি নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন, তাহলে তাকে কি পূর্ণাঙ্গ তথ্য বলা যাবে? অভিযোগ রয়েছে, যারা বাজার মনিটরিংয়ে নিয়োজিত থাকেন, তাদের অনেকেই পণমূল্যের তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যক্তিগতভাবে বাজারে গমন করেন না। তারা বিভিন্ন সূত্র থেকে অবহিত হন পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি কমেছে। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আগের মাসের তথ্যকে কিছুটা হ্রাস-বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতির হার প্রদর্শন করেন। ফলে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির যে হার প্রদর্শন করে তার সঙ্গে বাজার বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না।
অনেকের মধ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে, কোনো একটি বা দুটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলেই তাকে মূল্যস্ফীতি বলে মনে করেন; কিন্তু আসলে তা নয়। মূল্যস্ফীতি পরিমাপের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পণ্যকে বিবেচনায় নেয়া হয়। অর্থনীতির পরিভাষায় কোনো একটি বা দুটি নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকে মূল্যস্ফীতি বলা হয় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করে থাকে। তারা নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের গড় মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসকে বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করে থাকে। এই নির্দিষ্ট পণ্যগুলো আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। কোনোটি শহরের জন্য আবার কোনোটি গ্রামের জন্য। শহরের জন্য মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের জন্য ৪২২টি পণ্যকে বিবেচনায় নেয়া হয়। আর গ্রামের ক্ষেত্রে ৩১৮টি পণ্যকে বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতি পরিমাপ করা হয়। এসব পণ্যের গড় মূল্য যদি বৃদ্ধি পায়, তাকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার যদি এসব পণ্যের গড় মূল্য হ্রাস পায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হয়েছে বলে মনে করা হয়। মূল্যস্ফীতিকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে একটি খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি এবং অন্যটি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি। যে ৭৪০টি পণ্যকে বিবেচনায় নিয়ে শহর ও গ্রামে মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করা হয় তার মধ্যে এমন কিছু পণ্য আছে যা ভোক্তারা খুব একটা ক্রয় করে না।
তাই এসব কার্যত অপ্রয়োজনীয় পণ্যকে মূল্যস্ফীতি গণনা থেকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মূল্যস্ফীতি আর মুদ্রাস্ফীতিকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। মূল্যস্ফীতি আর মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে একই রকম হলেও এ দুটি শব্দের ভিন্ন অর্থ অবশ্যই লক্ষ্যণীয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকাকালে বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে সাধারণভাবে তাকে মূল্যস্ফীতি বলা হয়। আবার কোনো সময় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যেতে পারে। ‘স্ফীতি’ শব্দের অর্থ স্ফীত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া। বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে তাকে মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যেতে পারে। একবার একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মানি লন্ডারিং বলতে আমরা কী বুঝবো? তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং হচ্ছে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাওয়া। আমি তার উত্তর শুনে বিস্মিত হলাম।
কারণ মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার এক বিষয় নয়। অর্থ পাচার মানি লন্ডারিংয়ের একটি কৌশল হলেও কোনোভাবেই সার্বিক মানি লন্ডারিং বুঝাতে অর্থ পাচার শব্দটি ব্যবহার করা যায় না। মানি লন্ডারিং হচ্ছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবৈধ অর্থ বৈধ করার পন্থা। সেটা দেশের অভ্যন্তরেও হতে পারে আবার বিদেশেও হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, মানি লন্ডারিং শব্দটি এসেছে ‘লন্ডি’ শব্দ থেকে। মানুষ ময়লা কাপড় লন্ড্রিতে দিয়ে যেমন পরিষ্কার করে আনে। তেমনি অবৈধ অর্থকে নানাভাবে বৈধতা দানের একটি পন্থা হচ্ছে মানি লন্ডারিং। পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির আর একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে মানি লন্ডারিং। মানি লন্ডারিং এবং অর্থ পাচার নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়, তার অধিকাংশই অনুমান নির্ভর এবং বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কিছুদিন আগে এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করেন, স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে; কিন্তু ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক এক প্রেসিডেন্ট বলেছেন, প্রতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ অর্থ মানি লন্ডারিং করা হয় তা বিশ্ব জিডিপির ২ থেকে ৫ শতাংশের সমান। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার থেকে ২ লাখ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে বলা হয়,বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমির পরিমাণ জিডিপির ৩৭ শতাংশ হতে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য যে মোটেও শতভাগ নিশ্চিত নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ তারা যদি নিশ্চিত হতেন, তাহলে নির্দিষ্ট করে অ্যামাউন্ট উল্লেখ করতেন। বিশ্ব জিডিপির ২ থেকে ৫ শতাংশ পরিমাণটি কি অদ্ভুত হয়ে গেল না? আমরা সাধারণত কোনো পরিসংখ্যান সম্পর্কে নিশ্চিত হলে সুস্পষ্টভাবে সংখ্যাটি উল্লেখ করি। আর নিশ্চিত না হলে বলি, ৩০ থেকে ৩২ অথবা ৮০ থেকে ৮৫ হতে পারে। কিন্তু এখানে যে পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাঝে গ্যাপ অনেক বেশি। ফলে এই পরিসংখ্যানকে নিশ্চিত বলা যেতে পারে না। যারা অনৈতিক আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তারা কখনোই তাদের উপার্জিত এবং ব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ কারও কাছে প্রকাশ করে না। কালো টাকা বা মানি লন্ডারিংকৃত অর্থের হিসাব সংরক্ষণের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। কাজেই এসব তথ্য যে বিভ্রান্তিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কালো টাকা (ব্ল্যাক মানি) এবং অপ্রদর্শিত অর্থ (আনডিসক্লোজড মানি) এই শব্দ দুটি অনেকেই একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন, যা মোটেও ঠিক নয়। অধিকাংশ বছরই জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু সাধারণত সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেন না। প্রকৃত পক্ষে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থের মধ্যে সুস্পষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। যে অর্থ অবৈধভাবে উপার্জিত (যেমন, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি) এবং দেশের প্রচলিত ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে থাকে তাকে সাধারণভাবে কালো টাকা বলা হয়। আর যে অর্থ বৈধভাবে উপার্জিত কিন্তু প্রযোজ্য ট্যাক্স প্রদান করা হয় না অর্থাৎ ট্যাক্স নেটওয়ার্কের বাইরে রাখা হয়, তাকে অপ্রদর্শিত অর্থ বলা হয়। কালো টাকার মালিকরা একই সঙ্গে দুটি অপরাধ করেন। আর অপ্রদর্শিত অর্থের মালিকরা একটি অপরাধ করেন। কাজেই এই দুটি শব্দকে একই অর্থে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। অনেক সময় বলা হয়, ব্যাংক কোনো প্রকল্পের অনুকূলে গৃহীত ঋণ মওকুফ করেছে। এটা অজ্ঞতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ মূল ঋণ মওকুফ করার কোনো ক্ষমতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নেই। ব্যাংক শুধু আরোপিত সুদ এবং দণ্ড সুদ মওকুফ করতে পারে মাত্র।
গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, এটা সত্যি কিন্তু পাচারকৃত সেই অর্থের পরিমাণ কি নিরূপণ করা সম্ভব? অনেকেই অনেকভাবে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করছেন কিন্তু এসব পরিসংখ্যানকে শতভাগ নিশ্চিত বা বিশ্বাসযোগ্য মনে করার কিছু নেই। কারণ যারা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন এবং বিদেশে পাচার করেছেন তারা নিশ্চয়ই কোনো প্রমাণ রাখেননি। অর্থনীতি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিভিন্ন সূত্র সময়ের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত এবং সংশোধিত হতে পারে। কোনো কিছুই অপরিবর্তনীয় নয়।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে