Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

রমজানকে সামনে রেখেই কেন জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি!

Mamun–Or–Rashid

মামুন–অর–রশিদ

বৃহস্পতিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রমজানের আগে পণ্যের দামে ছাড় দেয়। ঠিক এর উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখা যায় আমাদের দেশে। এমন ঘটনা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের দামের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো একই ঘটনা ঘটবে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সেই মূল্যস্ফীতি আরও এক দফা উসকে দেবে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিভাগ বলছে মার্চের শুরু থেকেই বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক রমজানের আগেই এ ধরনের পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করতে হলো?

বিদ্যুৎ জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হবে ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত। অন্যদিকে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক বাজারদরকে ভিত্তি ধরা হবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়বে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে বাংলাদেশেও কমানো হবে। এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময় পরপর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে অন্য ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে অপরিবর্তীত রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৭০ পয়সা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের গ্যাসের দাম না বাড়লেও বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এই দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কেবলমাত্র সরকারি, আইপিপি এবং রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম বেড়েছে তা নয়, একই হারে বেড়েছে শিল্পের নিজস্ব ব্যবহারের ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম।

সরকার বলছে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি খাতে এই ভর্তুকির পরিমাণ ছয় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ভর্তুকির পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার হিসেবে এর পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলার। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সরকার দেশের বাইরে থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কয়লা এবং এলএনজি আমদানি করা হয়। অর্থাৎ এই দুটি জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রেই ডলারের প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে টাকার সংস্থান করা সম্ভব হলেও সেই টাকাকে ডলারে রূপান্তর করা আরও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। ইতোমধ্যে জ্বালানি আমদানি, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ডলারের সংকট চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

সরকার মনে করছে তাদের পক্ষে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মূল্য সমন্বয় করে ভর্তুকি তুলে দেয়া হবে। তবে চার বিলিয়ন ডলারের মতো বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি তুলে দিলে বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য ইউনিট প্রতি বাড়িয়ে ১২ থেকে ১২ টাকা ৫০ পয়সা করতে হবে।

এখন গড় বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ৮ টাকা ২৫ পয়সা; কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী উৎপাদন খরচ ১২ টাকা। অর্থাৎ ইউনিট প্রতি গড়ে লোকশান হচ্ছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই ভর্তুকি সমন্বয় করা হবে। তবে চলতি বছর এই একবারই যে দাম বাড়ছে তা নয়। চলতি বছর আরও কয়েকবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হবে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩-এ তিন ধাপে ৫ ভাগ করে মোট ১৫ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। চলতি বছর যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে অন্তত আরও দুবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হবে।

জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ কেবল বেশি বিল পরিশোধ করেন বিষয়টি এমন নয়। কৃষি এবং শিল্পের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পরিবহন ব্যয়ের ক্ষেত্রে কাঁচামাল পরিবহন এবং তৈরি পণ্য পরিবহন দুই জায়গাতে খরচ বেড়ে যায়।

জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে সরকারের বিশেষ উৎসাহ রয়েছে কেবল এমন নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে আমরা যে ঋণ নিয়েছি তারাও মূল্য সমন্বয়ের শর্ত দিয়েছে। পাশের দেশ ভারত আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে।
কিন্তু আমাদের দেশে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল দিয়ে এখনো বেশিরভাগ কৃষক সেচ দেয়। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে বাজারকে প্রভাবিত করে। গত বছরের চেয়ে চলতি বছর চাল, ডাল, সবজি সব কিছুর বাজারদর চড়া ছিল। এখন যদি আবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পায় সেক্ষেত্রে কৃষি পণ্যের দর আরও এক দফা বাড়বে। এই বৃদ্ধি মানুষ খুব সহজেই মেনে নিতে পারত, যদি তার আয় বৃদ্ধি পেত; কিন্তু দেশে গত এক বছরে মানুষের আয় বৃদ্ধি তেমন ঘটেনি। ফলে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানুষকে নতুন সংকটে ফেলবে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধীত তেলের দাম বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৯১ ডলারে উঠে যায়। চলতি বছর জানুয়ারিতে ক্রড অয়েলের দাম কিছুটা কম থাকলেও এখন তা বেড়ে আবার ৭৮ ডলারের ওপরে চলে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী কয়েক মাসে এই দর আরও বাড়বে।

আন্তর্জাতিক বাজারে গত দুমাসে কয়লার দাম টনপ্রতি ১৫৬ থেকে ১২৭ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। ফলে আপাতত কয়লার দামও স্থিতিশীল নয়। কোনো কারণে এটি আরও বেড়ে গেলে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রর উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে দেশের বড় তিন প্রকল্পের সঙ্গে ভারতের আদানি-বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকবে। সেক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি তুলে নিতে চাইলে গ্রাহক পর্যায়ে গড় লোকশান ৩ টাকা ৭৫ পয়সার চেয়ে আরও বাড়াতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। এ জন্য বিশেষ বন্ড ছেড়ে অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর বাইরে দাম বৃদ্ধির পর সরকারের হাতে বড় অঙ্কের অর্থ জমা হবে। যা দিয়ে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে। তবে কতটা দাম বৃদ্ধি মানুষের জন্য সহনীয় হবে, তাও বিশ্লেষণ করা জরুরি। দাম বৃদ্ধির আগে সেই বিবেচনা কখনোই করা হয় না। এবারও যেমন রমজান আর ঈদের খরচার মধ্যেই দাম বৃদ্ধির এই খবর মানুষকে হতাশ করছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ