যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বাকি বিশ্বের মাথাব্যথা
৪ নভেম্বরের গল্প। না, পরাবাস্তব বা যাদুবাস্তব গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারে ঢুকলাম দুপুরবেলা। রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে বসে শাক-সবজি বিক্রি করছে অত্যন্ত দরিদ্রপীড়িত, শিক্ষাবঞ্চিত খেটে খাওয়া প্রান্তিক পর্যায়ের কিছু মানুষ। হঠাৎ কানে এলো তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন তার জন্ম এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘ইবার ট্রাম্প হইয়া যাবি’। আমার কান সচেতন হয়ে উঠল। ইন্টারেস্টিং ডিসকাশন! দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি একটা মলিন স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি এবং খালি পায়ে বসে লালশাক, পুঁইশাক বিক্রি করছেন লোকটি। প্রায় একই রকম কন্ডিশনের আরেকজন বিক্রেতা তার কথায় সায় দিয়ে মাথা দোলাচ্ছেন।
বাংলাদেশের অনেক কূটনীতিক এবং সাবেক সচিবের সঙ্গে আমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টেলিফোনে আলাপ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিগত দু-তিন মাস ধরে তাদের অনেক গতানুগতিক আলোচনা শুনেছি; কিন্তু এই দুজন শাক বিক্রেতার আলোচনা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। যে মানুষগুলোর যুক্তরাষ্ট্রকেই চেনার কথা না, সেই মানুষরা হিসাব কষছেন কে হবে দেশটির প্রেসিডেন্ট! কেন! এভাবে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছেও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল কী করে। শুধু একটি সংবাদ ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কখনোই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়নি। এবার কেন?
আমি লোকটির কাছে জানতে চাইলাম, ট্রাম্প হলে বা না হলে আপনার লাভ কী? তাকে একটু লজ্জিত মনে হলো। যেন ভদ্রলোকদের আলোচনা তারা নিজেরা করে অন্যায় করে ফেলেছে। আমি প্রশ্নের জবাবের জন্য অপেক্ষা করলাম। তিনি বুঝতে পেরে বললেন, ‘আমাগো কী, যেই হোক আমাগো কাজ কইরাই খাওয়া লাগবে।’
আমি আরও অবাক হলাম তার কথায়। যে কথাটি খেটে খাওয়া মানুষ বাংলাদেশের নির্বাচনের সময় নেতাদের ব্যাপারে বলে থাকেন, সেই একই কথা তিনি বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে! তার মানে কি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে রিলেট করছেন! আর কখনো কি আমরা দেখেছি এদেশের সাধারণ মানুষের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে এমন মাথাব্যথা! না, কখনোই না।
শুধু বাংলাদেশ নয়, রাশিয়া, ইউক্রেন, লেবানন, গাজা, দুই কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, ভারত, সুদান, কঙ্গো, মেক্সিকো এবং ন্যাটো জোটের জন্য এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূণ। চার বছর পরপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় নভেম্বর মাসের প্রথম যে সোমবার, তারপরের দিন মঙ্গলবার। সে হিসাবে এবারের নির্বাচন ৫ নভেম্বর। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে যে ভোটযুদ্ধ আমরা বিগত কয়েক মাসে আমরা দেখলাম, তা দেশটির নির্বাচনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটা ধরে নেয়া যায় যে, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাইডেন প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতি অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসের সরাসরি মেনটর হলেন সাবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যে বলয়ের মধ্যে সাবেক ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনও আছেন। হিলারি ২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে ইলেক্টোরাল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। যা হোক, সেই নীতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বেশি গতিশীল অথবা শিথিল হতে পারে; কিন্তু ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে তিনি জলবায়ুবিষয়ক প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে পারেন, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক মানুষসহ বিশ্বের সব দেশ উদ্বিগ্ন।
ন্যাটোর ব্যয় কমিয়ে দেবেন নিঃসন্দেহে, যা ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলছে। সেইসঙ্গে বহু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই হবে। যেসব দেশে ডেমোক্র্যাট দলের সহযোগিতা আছে, সেসব দেশ থেকে ট্রাম্প সহযোগিতার হাত তুলে নেবেন এবং এসব এত তীব্রভাবে স্পষ্ট যে বিশ্বের অতি সাধারণ মানুষের কানেও পৌঁছে গেছে।
কে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন- আমি সেই ধারণায় যাচ্ছি না; কিন্তু বিশ্বে যে নিউ অর্ডার চলছে তাতে যেই প্রেসিডেন্ট হোক, তার জন্য সবকিছু ডিল করা সহজ হবে না। যেমন নতুন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল-গাজা-লেবানন যুদ্ধ বিষয়ে কী ভূমিকা রাখবেন? সেখানে শুধু যুদ্ধই চলছে না, ইসরায়েল জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ইসরায়েলের মাটিতে ‘পারসনা নন গ্রাটা’ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের বক্তব্য হলো, একজন জাতিসংঘের কর্মকর্তাকে একটি দেশ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারে না। কারণ তিনি কোনো কূটনীতিন নন, তিনি ইন্টান্যাশনাল সার্ভিসের প্রধান। যদিও এর আগে ইথিওপিয়া, মালি, আর্মেনিয়া, সুদান জাতিসংঘের কর্মীদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে; কিন্তু সেই ঘটনা আর ইসরায়েলের ঘটনা এক নয়, এক মাত্রার নয়। একদিকে দেশটি ইসরায়েল, অন্যদিকে তারা নিষিদ্ধ করেছে খোদ সেক্রেটারি জেনারেলকে। জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় দাতা যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের বন্ধুও যুক্তরাষ্ট্র, যদিও বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে টানাপোড়েন আছে। এই জটিল অবস্থা কীভাবে নতুন প্রেসিডেন্ট ডিল করবেন?
তারচেয়েও আরও বড় ঘটনা হলো, ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর ব্রিকসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো রাশিয়ায়। চীন, ভারত ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রাশিয়ার মতো বড় দেশগুলোর সঙ্গে এবার যোগ দিয়েছে আরও ১৩টি দেশ এবং আরও ৯টি দেশ যোগদানের অপেক্ষায়। এবারে ব্রিকসের একটি বড় ঘটনা হলো চীন এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বড় ধরনের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্কের কারণে হয়তো ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক জায়গায় পৌঁছবে; কিন্তু কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হলে বিষয়টি কীভাবে দেখবেন? অর্থাৎ ভারতের পুরোপুরি রাশিয়া চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার যে সম্ভাবনা আছে, সেটা কী করে মোকাবিলা করবেন? যদিও বলা হয়ে থাকে, ব্রিকস একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতার সংগঠন; কিন্তু বুঝতে কারও বাকি নেই যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার প্রচেষ্টা। ডলারের প্রভাবকে কমিয়ে আনাই এখন ব্রিকসের মূল টার্গেট। আর সেটা করতে গিয়ে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এরপর রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ান সংকট, ইরান সংকট এবং এর সবকয়টি সমস্যাই বর্তমানে তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া ছোট ছোট কিছু দেশে বাইডেন প্রশাসনের যে প্রভাব রয়েছে, তা ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে পরিবর্তন হতে পারে। বিশ্ব এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখে রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সেই সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সঙ্গে যে খুবই রিলেটেড, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছেও এই নির্বাচন এতটা গুরুত্ব বহন করছে। দেখা যাক, ফলাফল কী হয়। পুরোপুরি ফল পেতে দু-একটি দিন অপেক্ষা করতে হবে।
মহসীন হাবিব: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে