Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

শ্বেতপত্র ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতহস্তি

যে কারণে শ্বেতপত্র কোনো আলোড়ন তোলেনি

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

ন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিটি করেছে। ‘স্বৈরাচারের’ রেখে যাওয়া অর্থনীতির ওপর পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটি সম্প্রতি একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে এবং শ্বেতপত্রের ওপর সাংবাদিক সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট কমিটি শ্বেতপত্রের তথ্য-উপাত্তের ব্যাখ্যা করেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য থেকে প্রতিপন্ন হয়, বিগত সরকারের আমলে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল এবং তাতে অংশ নিয়েছে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই। শ্বেতপত্র বলছে, বিগত ১৫ বছরে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেনি, কারণ চোর ধরা নয়, চুরির বর্ণনা দেয়াই নাকি শ্বেতপত্রের কাজ। তাই শ্বেতপত্র শুধু চুরির প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে হলে দুদক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে ধর্ণা দিতে হবে।

বিগত ১৫ বছরে মন্ত্রীর চেয়ে সচিবের ক্ষমতা ছিল বেশি। মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয় চালানোর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না বলে তারা আমলার ওপর ছিলেন বেশি নির্ভরশীল। তবে সব আমলা বা সব মন্ত্রী দুর্নীতিবাজ ছিলেন তা কিন্তু নয়, কিন্তু সৎ লোকগুলো এত অথর্ব ছিলেন যে, ভালো-মন্দ বিচার করার দক্ষতাও তাদের ছিল না। তাই কানাডার ‘বেগমপাড়া’ গড়ে উঠেছে আমলাদের দুর্নীতির টাকায়। দুর্নীতি এত ব্যাপক আকারে ছিল যে, প্রধানমন্ত্রীর পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিল। হবে না কেন, বাসার পিয়নের ক্ষমতা ছিল যে কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চেয়ে বেশি। আমলা-মন্ত্রী সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতিমানব রূপে চিত্রায়িত করতে ব্যস্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো মন্ত্রী বা আমলার কদর না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসার পিয়ন হয়ে উঠেছিল মিনি স্বৈরাচার।

কমিটি একটি অসার শ্বেতপত্র অন্তর্বর্তী সরকারকে উপহার দিয়েছে। শ্বেতপত্রে যা যা বলা হয়েছে তার প্রায় সব কথাই বিগত ১৫ বছরে মিডিয়া এবং টকশোতে বলা হয়েছে। ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতি প্রচারে মিডিয়া কখনো বাকরুদ্ধ ছিল না। বিগত ১৫ বছরে মূল্যস্ফীতি, বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুরবস্থা অহরহ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে। কানাডার ‘বেগমপাড়ার’ কথা শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন এবং অর্থ পাচারে আমলারা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। শেখ হাসিনার আমলেই ক্যাসিনোকাণ্ড উদ্ঘাটিত হয়েছে, বেনজীর আর মতিউরের দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার হয়েছে।

অন্যদিকে ‘চামচা-পুঁজিবাদ’ থেকে ‘চোরতন্ত্রের’ উদ্ভব- কমিটির মুখে উচ্চারিত শব্দ যুগল কোনো নতুন ধারণার সৃষ্টি করেনি, ব্রিটিশ আমলেও চামচা চোরদের উপদ্রব ছিল। অজ্ঞাত লেখকের ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে ব্রিটিশ আমলে চাকরির জন্যে উৎকোচ, স্বজনপোষণ, পুলিশি জুলুম, দারোগার আর্থিক আনুকূল্যের বিনিময়ে ‘কেস’ ঘুরিয়ে দেয়া, ভুয়া রিপোর্ট পেশ করা, উৎকোচের বিনিময়ে ‘ভুল’ বিচার করার জ্বলন্ত ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। উল্লিখিত অপরাধগুলো ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমলে, পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ আমলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো হচ্ছে, কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের ‘ট্যাগ’ লেগে যাওয়ার ভয়ে সবার মধ্যে কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

যে দেশের ভোটার প্রার্থীর যোগ্যতা বিচার না করে দলীয় মার্কা বিচার করে ভোট প্রদান করে সেই দেশে ‘চামচা’ তৈরি হবেই। আমলা, মন্ত্রী দুর্নীবাজ বলেই তারা ‘ইয়েস মিনিস্টার’। শেখ হাসিনার পতনের মূল কারণও সাংবাদিকদের তোষামোদি প্রশ্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা নতুন তোষামোদি লোকে ভর্তি। এদের আচরণ দেখলে মনে হয়, আওয়ামী লীগ তাড়াতে পারলেই সব অপরাধের অবসান হবে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত আর কোথাও অপরাধী নেই, দুর্নীতিবাজ নেই, অর্থ পাচারকারী নেই। কিন্তু অতীত বলে, সব রাজনৈতিক দলেরই একই অবস্থা, ‘লেজ কুকুর নাড়ায়, কুকুর লেজ নাড়ায় না’। তাই আওয়ামী লীগ বিরোধী হলেই ‘ফেরেশতা’ হয় এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়ার রীতি পরিহার করা আবশ্যক, নতুবা বিদেশে এবার ‘সাহেবপাড়া’ হবে।

শ্বেতপত্র বলছে, ২৮ উপায়ে দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এগুলো সব সরকারই জানতো; কিন্তু রোধ করার ক্ষমতা ছিল না। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস এবং আন্ডার ইনভয়েস করে ব্যবসায়ীরা যত অর্থ পাচার করেছে তত অর্থ অন্য কোনো একক শ্রেণি পাচার করেছে বলে মনে হয় না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সততা থাকলে হয়তো ওভার ইনভয়েস এবং আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার কিছুটা কমানো যেত, তবে বন্ধ করা যেত না। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার দেশের কথিত সৎ লোকেরাও করে। সরকারের তরফ থেকে যেসব প্লট-ফ্ল্যাট প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশ বিক্রি হয়ে গেছে এবং বিক্রির সমুদয় অর্থ ইতোমধ্যে বিদেশে পাচারও হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ভিন দেশে যাদের নাগরিকত্ব রয়েছে তারাও তাদের বাপ-দাদার সমুদয় সম্পত্তি বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিদেশে পাচার করছে। সব রোগীই হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ নিয়ে চিকিৎসা খরচ মেটায়। বিদেশে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর বাড়তি খরচও হুন্ডির টাকায় মেটানো হয়। এসব অর্থের সঙ্গে দুর্নীতির হয়তো কোনো সম্পর্কই নেই, নিজের অর্থ আইন ভঙ্গ করে অবৈধ পথে পাচার করা হচ্ছে মাত্র। তাই পাচার করা সব টাকা দুর্নীতির টাকা নয়। ওভার ইনভয়েস এবং আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যে অর্থ পাচার করে তাও বৈধ টাকা, শুধু পাঠায় অবৈধ পথে।

শ্বেতপত্র বলছে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিগত ১৫ বছরে বিদেশে পাচার হয়েছে। বিরাট অঙ্ক। কিন্তু এই হিসাব ধারণা বা অনুমাননির্ভর। কিন্তু ধারণার বশবর্তী হয়ে অনুমাননির্ভর শ্বেতপত্র প্রণয়নে ২৫ কোটি টাকার সমমূল্যের পরিশ্রম করার দরকার ছিল বলে মনে হয় না। অনুমান বা ধারণা দিয়ে কোনো কিছু বিচার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না। অস্তিত্ববিহীন এই সব তথ্য-উপাত্ত দুদক বা ফাইনানশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের তদন্ত কাজেও লাগবে না। শুধু বিগত ১৫ বছর কেন, তার আগে কি অর্থ পাচার হয়নি? দেদার হয়েছে। মালয়েশিয়াকে ‘সেকেন্ড হোম’ যারা করেছে তাদের অর্থ পাচার শুরু হয়েছে ১৫ বছর আগেই। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজেরা পালিয়ে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে আশ্রয় নিয়েছিল।

শ্বেতপত্র বলছে, দুর্নীতি নিয়ে গাওয়া কাহিনী কোনোভাবেই প্রমাণক দ্বারা সমর্থিত নয়। তাহলে শ্বেতপত্র রূপকথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কমিটির ধারণা বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতে। শ্বেতপত্র আরও বলছে, বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোতে। এসব পুরনো কাসুন্দি গাওয়ার জন্য জাঁদরেল জাঁদরেল অর্থনীতিবিদদের এত কষ্ট করার দরকার ছিল কি? কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয়েছে তা অন্তর্বর্তী সরকার আসার আগের মিডিয়ায় অনুল্লেখ্য ছিল না। বিএনপি প্রায়ই বলত, মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ বৃদ্ধির পশ্চাতে অর্থ তছরুপের দুরভিসন্ধির কথা শেখ হাসিনার আমলে অহরহ উচ্চারিত হয়েছে। বিদ্যুৎ আর অবকাঠামোতে দুর্নীতি বেশি হয়েছে, কারণ এই দুটি খাতে খরচও বেশি হয়েছে- এটা ধারণা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণার প্রয়োজন ছিল না। এই দুই খাতে দুর্নীতি নয়, জনগণের ধারণা লুট হয়েছে। যারা লুট করেছে তারা রাজনীতি করে না, তারা শ্বেতপত্রে উল্লিখিত ‘চামচা’। এদের অধিকাংশ ভোল পাল্টিয়ে বহালতবিয়তে এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের চামচামি করে যাচ্ছে। বর্তমানে আমলা আর মিডিয়া কি চামচামি করছে না? করছে। অনেকের ধারণা, এই চামচাগিরির কিছুটা ভয় প্রসূত, আর বাকিটা অভ্যাসগত। এখন ‘চামচা’ না হলে মালিকানা বা চাকরি কোনোটাই থাকছে না। শ্বেতপত্রের কথা অনুযায়ী শেখ হাসিনা শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। কিন্তু ধারণা এবং অনুমাননির্ভর শ্বেতপত্র দুঃখজনকভাবে কোনো আতঙ্ক তৈরি করতে পারেনি।

ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। পাচার করা অর্থের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা কোথাও পাইনি। অবশ্য পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক করার প্রয়োজনও নেই, কিন্তু পাচারে যারা সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সুনির্দিষ্ট পারপাস ছাড়া কাউকে ব্যাংক থেকে একটি টাকাও লোন দেয়া হয় না, অনুমোদিত লোন সুনির্দিষ্ট পারপাসে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নিবিড়ভাবে তদারকি করে থাকে। এর বাইরে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন। তফশিলি ব্যাংকের অডিট আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কেন এই পাচার আগে ধরা পড়ল না- তার কৈফিয়ত কি চাওয়া হয়েছে? যারা দুর্নীতি করেছে, বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের ‘চামচা’ হলেও তাদের সবাই কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক ছিল না। তাই প্রশাসন থেকে শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বের করা হলেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে না, আওয়ামী লীগ বিরোধী দুর্নীতিবাজদেরও শনাক্ত করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের অতি কথনের কারণে ইতোমধ্যে অনেকগুলো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, কয়েকটি ব্যাংকের সৎকার প্রলম্বিত করে পুনরায় জীবিত করা যাবে কিনা সন্দেহ। এসব ক্ষেত্র চরম বিপর্যয়ের জন্য শুধু স্বৈরাচারকে দায়ী করে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না, দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেও নিতে হবে।

শ্বেতপত্র ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতহস্তি; এখানে স্ববিরোধী বক্তব্যও আছে। ১২ জন নামজাদা অর্থনীতিবিদ এই শ্বেতপত্র প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত। তাড়াহুড়া করে রিপোর্ট প্রণয়ন না করে আরও সময় নিয়ে দুর্নীতির তলা উদঘাটন করলে দেশ উপকৃত হতো। দুর্নীতির প্রক্রিয়া-পদ্ধতি জানার কোনো আগ্রহ জনগণের নেই, তারা চায় দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের উচ্ছেদ। তা করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকেই। দলীয় সরকারের পক্ষে দুর্নীতির উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়, কারণ কোনো রাজনৈতিক দল স্বীকার করে না যে তাদের নেতারা দুর্নীতি করতে পারে। তাই ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতির সবগুলো মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-প্রসূত অভিধায় অভিহিত করে নিষ্ক্রিয় ও বাতিল করে দেয়া হয়। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারও একই কাজ করছে।

শ্বেতপত্রে কিছু সস্তা কথাও বলা হয়েছে। বিরোধী দলের হরতালের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগেকার সরকারগুলো বলতো, হরতালে যা ক্ষতি হয়েছে তা দিয়ে ২০টি বা ৪০টি পদ্মা সেতু করা যেত। শ্বেতপত্রও একই সুরে কথা বলেছে, বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে তা দিয়ে নাকি ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব হতো। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কেও এমন কথা বলা হয়, নজরুলের বাকশক্তি রুদ্ধ না হলে নাকি সাহিত্য রচনায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যেতেন, নোবেল পুরস্কার তিনিই পেতেন, রবীন্দ্রনাথ নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার পর ১৯৪২ সালে বাকরুদ্ধ হওয়ার মধ্যবর্তী ২০ বছরে কাজী নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো আরেকটি কবিতা লিখতে পারেননি। তাই দুর্নীতি না হলেই যে ব্রিজ হতো এমন নজির অতীতে পরিলক্ষিত হয়নি, এখনো হচ্ছে না।

বিগত ১৫ বছরে লুটপাট হওয়ার পরও বাংলাদেশ কীভাবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য সমস্ত মানদণ্ড পূরণ করল তার ব্যাখ্যায় গোঁজামিল দিয়েছে শ্বেতপত্র। কমিটির মতে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ বিধায় গ্র্যাজুয়েশন স্থগিত করার কোনো কারণ নেই। কমিটির শ্বেতপত্র অনুযায়ী উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ চুরি হয়ে গেলে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয় কী করে! প্রকৃতপক্ষে শ্বেতপত্র শেখ হাসিনার আমলের একটি সত্য অস্বীকার করতে পারেনি এবং তা হচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনামলে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, উন্নতি হয়েছে বলেই কমিটি বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের গ্র্যাজুয়েশন গ্রহণ করা যথার্থ হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে। এত ঢাকঢোল পিটিয়ে শ্বেতপত্র শেষ পর্যন্ত বিগত ১৫ বছরের প্রশংসাই করল। তাই এই শ্বেতপত্র টাকা খরচ করে মুদ্রণ না করাই শ্রেয় হবে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: কলামিস্ট ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ