টিউলিপের পদত্যাগ: ব্রিটিশদের কাছে তুচ্ছ হলেও বাংলাদেশিদের কাছে মুখ্য কেন?
বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের নাম এসেছে। তার পরিবার এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। আর তাই ব্রিটেনের ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দি ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্তে তার নাম আসার পর থেকেই তার ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়ছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে দুর্নীতির একটি মামলায় তার মা, ভাই বোন ও খালার পাশাপাশি তাকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে টিউলিপ সিদ্দিক বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেটের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের স্ট্যান্ডার্ডস উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে পুরো ঘটনা তুলে ধরেছিলেন। সেইসঙ্গে জোর দিয়েছিলেন যে তিনি কোনো ভুল করেননি। তারপরেও এটা স্পষ্ট যে ট্রেজারির অর্থনৈতিক সচিব হিসেবে আমার ভূমিকা অব্যাহত রাখা সরকারের কাজ থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারে। লেবার এমপি এমা রেনল্ডসকে ট্রেজারির নতুন অর্থনৈতিক সচিব নিযুক্ত করা হয়েছে। টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৫ সালে উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেইট আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, যে আসনটি প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের আসন হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের লাগোয়া। মন্ত্রী হিসেবে টিউলিপ সিদ্দিকের দায়িত্ব ছিল যুক্তরাজ্যের আর্থিক বাজারে দুর্নীতি মোকাবিলা করা। গত মাসে তার পরিবারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবকাঠামোগত ব্যয় থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তে নাম প্রকাশ করা হয়। তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি আওয়ামী লীগের প্রধান।
গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। লন্ডনে তার খালার সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্কিত সম্পত্তি ব্যবহারের কারণে সিদ্দিক তীব্র তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক জোর দিয়ে বলছেন যে, তিনি কোনো ভুল করেননি; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষণশীল নেতা কেমি ব্যাডেনোচের কাছ থেকে তাকে মন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে এক চিঠিতে স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, যে তার জন্য ‘দরজা খোলা রয়েছে’। মন্ত্রী পর্যায়ের মানদণ্ড সংক্রান্ত স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাস বলেছেন, যে তিনি সিদ্দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যায্যতার কোনো প্রমাণ শনাক্ত করতে পারেননি। লন্ডনের সম্পত্তির মালিকানা বা দখলের ক্ষেত্রে টিউলিপ সিদ্দিক অথবা তার স্বামীর নেয়া পদক্ষেপের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো অনৈতিকতার প্রমাণ আমি খুঁজে পাইনি, যদিও এটি সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
তাত্ত্বিক দিক থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের জন্য একটি রাজনৈতিক ধাক্কা হতে পারে। তবে এটি কোনো বড় সংকট নয়। টিউলিপ একজন স্বল্প পরিচিত রাজনীতিক; শীর্ষ সারির কেউ নন। সাধারণ মানুষের কাছে তার নাম খুব বেশি পরিচিত নয়। তাই তাকে সহজেই রাজনৈতিকভাবে বলি দেয়া সম্ভব। তবে বাস্তবতা হলো, তার পদত্যাগে সরকারের নীতিগত দিক পরিবর্তিত হবে না। স্বাভাবিকভাবেই এটি টিউলিপের জন্য একটি কঠিন ব্যক্তিগত মুহূর্ত। তবে ব্রিটিশ জনগণের কাছে এটি একেবারেই গৌণ একটি বিষয়; এবং এটাই স্বাভাবিক। খুব কম মন্ত্রীই সাধারণ মানুষের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারেন। তাদের মধ্যে যাদের পদত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকে। অধিকাংশ মন্ত্রীর পদত্যাগের প্রসঙ্গ সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যায়। টিউলিপ সিদ্দিকের ক্ষেত্রেও সেটি হবে।
তবে তার বিদায় থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেয়ার আছে, যা হচ্ছে, সিদ্দিক নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছেন। তার জানা উচিত ছিল, তার লন্ডনের ফ্ল্যাট ও সম্পত্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তার বোঝা উচিত ছিল, তিনি যেহেতু মন্ত্রী হতে ইচ্ছুক ছিলেন, বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সেহেতু তাকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই হতো; কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে তার খালা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এটি বিবেচনায় নিলে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তার নানা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তার খালা হাসিনা ১৫ বছর ধরে ক্রমে দমনমূলক নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ব্রিটেনে লেবার পার্টির বিজয়ের এক মাস পর, গত আগস্টে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
সিদ্দিকের উচিত ছিল হাসিনার পতনের আগে এবং পরে আরও সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা নেয়া, যাতে তার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা সন্দেহ ওঠার সুযোগ না থাকে। অবশ্য এখন যা ঘটে গেল তার জন্য তিনি একাই দায়ী নন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি রাজনীতিতে জনগণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচারণা চালায়। তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে রাজনৈতিক সংস্কারকে ভোটারদের জন্য একটি মূল প্রতিশ্রুতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী স্টারমার আগেভাগেই সু গ্রেকে নিয়োগ দেন। সু গ্রের দায়িত্ব ছিল দলকে সরকার পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা। তার অন্যতম কাজ ছিল সম্ভাব্য মন্ত্রীদের আর্থিক অবস্থা ও তাদের সন্দেহজনক কোম্পানি বা শাসকদের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে কঠোরভাবে যাচাই করা। রাজনীতি ও সরকারকে যে গভীর সংকট থেকে বের করে আনা দরকার সেটি লেবার পার্টির কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু তা হয়নি। বরং যখন ২০২২ সালে সিদ্দিকের সম্পত্তির বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন লেবার পার্টি তাকে রক্ষা করতে একাট্টা হয়ে যায়। এটি একধরনের প্রবণতা হয়ে ওঠে। স্টারমার ও গ্রের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি দলের শীর্ষ নেতাদের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি উদাসীন ছিল। স্টারমার ও অন্যান্য সিনিয়র নেতা, যেমন অ্যাঞ্জেলা রেইনার ও র্যাচেল রিভস আবাসন, পোশাক ও বিনোদনের জন্য ব্যবহার্য জিনিস উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন। যখন তাদের এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, তখন তারা ক্ষমা চাওয়ার বদলে বা নিয়ম কঠোর করার উদ্যোগ নেয়ার বদলে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
সিদ্দিকের ঘটনা সেই একই প্রবণতার প্রতিফলন। সম্প্রতি মন্ত্রীদের নৈতিক মানদণ্ড পর্যালোচনাকারী স্বাধীন উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস তার প্রতিবেদনে বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জন্য টিউলিপ সিদ্দিককে দোষ দেয়া যায় না; তবে এর ফলে টিউলিপ অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিলেন। দুঃখজনক যে তিনি তার ও সরকারের জন্য সম্ভাব্য মর্যাদাগত ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না। এটি অত্যন্ত মৃদুভাবে বলা হলেও, বিষয়টি কিন্তু খুবই গুরুতর।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, কিয়ার স্টারমারকেও এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। কারণ, বিরোধী দলে থাকাকালে তিনি বিশ্বাসযোগ্যতা ও সততার ওপর জোর দিলেও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেননি। তিনি মন্ত্রিসভার আচরণ বিধির হালনাগাদ অবস্থা প্রকাশ করতে দেরি করেছেন। অথচ এটি তার প্রথম দিনেই করা উচিত ছিল। দৃশ্যত টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রিত্বের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। তবে তদন্তকারী লরি ম্যাগনাস তাকে পুরোপুরি দায়মুক্তিও দেননি। নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সরকারি দায়িত্বের মধ্যে কোনো সংঘাত তৈরি হতে পারে এমন পরিস্থিতি এড়ানোর কথা ছিল। তবে এই নিয়ম খুবই দুর্বল ও অস্পষ্ট এবং তা আরও কঠোর করার প্রয়োজন হতে পারে।
রাজনীতিতে জনগণের বিশ্বাস কমে যাওয়ার জন্য শুধু রাজনীতিবিদরাই দায়ী নন, গণমাধ্যমও ভূমিকা রেখেছে। মূলধারা ও সামাজিক গণমাধ্যম রাজনৈতিক ভুলত্রুটি খুঁজে বের করে নেতাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। এখানে অনেক সময় অনেক ছোট ঘটনাকেও বড় করে দেখানো হয়। যেমন, মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে কমার বিষয়টি সাধারণ পরিবর্তন হলেও এটিকে অনেক সময় বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ ব্যক্তিগত ভুলের কারণে হলেও এটি আসলে বড় রাজনৈতিক সমস্যার একটা অংশ। তার ভুলগুলো দুর্নীতির মতো গুরুতর নয়, বরং অসাবধানতা ও অব্যবস্থাপনার ফল।
আগে মন্ত্রীরা কেলেঙ্কারির পর টিকে যেতে পারতেন; কিন্তু এখনকার রাজনীতিতে ছোট ভুলেও কড়া শাস্তি আসে। তার ঘটনা দেখায় যে রাজনীতিবিদদের জন্য এখন পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে, এটি প্রমাণ করে যে অনেক আধুনিক রাজনীতিবিদ এমন কঠোর পরিবেশ সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দক্ষ নন। গত পনের বছরের বেশি বাংলাদেশের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনাকে দেখা হতো একজন একনায়ক হিসেবে, যার সরকার নির্দয়ভাবে ভিন্নমতের ব্যক্তিদের দমন করত। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বহু অপরাধের অভিযোগ এনেছে বাংলাদেশের নতুন সরকার। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি)। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ওই আন্দোলনে সহিংসতায় কয়েকশ ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন।
তাছাড়াও সাবেক সরকারের মন্ত্রীসহ আরও ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ওই সব মন্ত্রীও দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন; কিন্তু কথা হচ্ছে, তিনি পালিয়ে গিয়ে হয়তো রক্ষা পেলেন কিন্ত ব্রিটেনে বাংলাদেশের গর্ব টিউলিপ সিদ্দিকের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎটাও তছনছ করে দিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাব মূর্তিতেও চরম আঘাত হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে থাকবে।
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে