Views Bangladesh Logo

মার্কিন শুল্কনীতি যে কারণে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে

M A  Khaleque

এম এ খালেক

বেশ কয়েক বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, অস্ত্র-শক্তি দিয়ে বিশ্ব জয় করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর শীর্ষ ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়েছে। আর রাশিয়া বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে পৃথিবীর বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিজস্ব জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করে চলেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, চীন যেভাবে বিশ্ববাজারে তার প্রভাব বিস্তার করে চলেছে তা বজায় থাকলে ২০৫০ সালের আগেই দেশটি অর্থনৈতিক শক্তির বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাবে। সংস্থাটির মন্তব্য যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। কয়েক বছর আগে জাপানের ৪৪ বছরের আধিপত্য খর্ব করে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

এমনকি চীন পারচেজিং পাওয়ার প্যারেটির (পিপিপি) বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে চীন এখনো জিডিপির আকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঙ্গনে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের মূল কারণই হচ্ছে চীনের অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভিযাত্রা। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কার্যকর জনশক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। তারা এমন সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ব্যবহার করছে যা অন্যদের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই চীনের ধারেকাছে যেতে পারছে না। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারও এখন ধীরে ধীরে চীনা পণ্যের দখলে চলে যাচ্ছে। অনেক দিন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে যে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রম ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে সুরক্ষা দেবার জন্যই করা হয়েছে। গত শতাব্দীর তিন এর দশকে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একইভাবে আমদানি পণ্যের ওপর অস্বাভাবিক হারে শুল্কারোপ করেছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন জাত ব্যবসায়ী। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থটাকেই প্রাধান্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। আগের টার্মে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষস্থানে থাকবে। সেই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশেষ করে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি চীনা আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই অভিযোগ করে আসছে, চীনা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের স্থানীয় মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময় হার কমিয়ে রাখছে। তারা ইউয়ানের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করছে না। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে চীনা পণ্যের নিকট মার্কিন পণ্য মার খাচ্ছে। চীন অবশ্য বরাবরই মার্কিনি অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

মার্কিন প্রশাসন সম্প্রতি ঢালওভাবে বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য লাওসের পণ্যকে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৪৮ শতাংশ হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। ভিয়েতনামকে ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কাকে ৪৪ শতাংশ, মিয়ানমারকে ৪৪ শতাংশ, বাংলাদেশকে ৩৭ শতাংশ, পাকিস্তানকে ২৯ শতাংশ, ভারতকে ২৬ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়াকে ২৫ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও জাপানকে ২৪ শতাংশ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ২০ শতাংশ এবং ইসরায়েলকে ১৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে করের হারে কিছুটা তারতম্য করলেও কোনো দেশকেই ছাড় দেয়নি। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ যে ইসরায়েল তার পণ্যের ওপরও ১৭ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করা হয়েছে। ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে মনে করে। দেশটি হয়তো আশা করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাবে। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ভারতের বিরোধী দলের নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য পি চিদারম্বর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করে তাহলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমদানিকৃত সব ধরনের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা ২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকায় ভারতীয় গাড়ি ব্যবসায়ের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। এতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে। ভারতে উৎপাদিত গাড়ির এক পঞ্চমাংশই আসে রপ্তানি থেকে। এর মধ্যে ২৭ শতাংশই আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এটা শুধু গাড়ি শিল্পের ক্ষতির পরিসংখ্যান সাধারণভাবে যে বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তার প্রতিক্রিয়া কতটা হবে তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চলে আসলে অনেক দিন থেকেই। প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ যখন তৈরি পোশাক রপ্তানির দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের এই শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে চমৎকার অবদান রেখেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া কোটা সুবিধা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বর্ধিত পরিমাণে তৈরি পোশাক এই দুটি অঞ্চলে রপ্তানি করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নেয়। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোটা সুবিধা প্রত্যাহার করলেও তারা সীমিত পরিসরে জিএসপি সুবিধা প্রদান শুরু করে। পরবর্তীতে শ্রম অধিকার এবং অন্য কয়েকটি ইস্যুতে বিরোধ সৃষ্টি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যা এখনো বহাল রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো যেসব দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক ভারসাম্য অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাম সবার আগে উল্লেখ করতে হয়।

বাংলাদেশ আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হতে চলেছে; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব ধরনের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা হারাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদিও বলেছে তারা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদান করবে। তারপর জিএসপি+ নামে এক বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশ জিএসপি+ সুবিধা পাবার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে না। যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে তা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ওপরও বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করে তাহলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ওপর দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব এই দুটি দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা শক্তিশালী। ২০২০ সালে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট ১৮৫ দশমিক ১৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয় ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য অর্থাৎ বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৪২১ দশমিক ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৩৫ দশমিক ০৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর বিপরীতে ৮২৮ দশমিক ৫৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৫৯৩ দশমিক ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে বাংলাদেশ মোট ২৯৪ দশমিক ৭২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয় ১ হাজার ১১৫ দশমিক ০৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৮২০ দশমিক ৩৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২৪ দশমিক ৭৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করে ৮২৭.৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। ফলে বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০২ দশমিক ৮৬ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে ২২১ দশমিক ৪০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয় ৮৩৬ দশমিক ৫৮ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। ফলে বাংলাদেশের অনুকূলে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৬১৫ দশমিক ১৮ কোটি মার্কিন ডলার।

অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, গত এক শতাব্দীর মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্যে এটাই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। কারণ এর আগে এভাবে এত বিপুল পরিমাণ শুল্ক আর আরোপ করা হয়নি। অর্থনীতিবিদগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগকে অন্যায্য বলে মন্তব্য করেছেন। তারা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে যেসব উন্নয়নশীল দেশ পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল তাদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। তারা মনে করছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই এক তরফা সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জন্য উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাণিজ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনা করলে অত্যন্ত ভয়ংকর পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের একক বৃহত্তম ক্রেতা দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর অঞ্চল হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করে তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সাংঘাতিকভাবে কমে যাবে। বাংলাদেশ এমন অবস্থানে আছে যেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ চাইলে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ইস্যুটি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো কোনো দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বর্ধিত শুল্ক হার ৩৭ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশে নির্ধারণের অনুরোধ জানাতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন করা এবং রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ।

একই সঙ্গে স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্যের উৎপাদন এবং রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যেসব পণ্য রপ্তানি করে তার মধ্যে বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ যেহেতু আমদানি করতে হয় তাই জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৬৩২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। এর মধ্যে ৬০ কোটি মার্কিন ডলার অর্জিত হয় তৈরি পোশাক খাত থেকে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ২১ কোটি মার্কিন ডলার, হোস টেক্সটাইল থেকে ৪ দশমিক ৭৯ কোটি মার্কিন ডলার, হিমায়িত খাদ্য খাতে ১ দশমিক ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার এবং পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আসে ১ দশমিক ৫২ কোটি মার্কিন ডলার।

আগামীতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াতে পারে। তৈরি পোশাকশিল্প তার বেশিরভাগ কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা এবং আরও নানা সামগ্রী আমদানি করা হয়। একক দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে ৮৪০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয় ৭৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হতো। আগামীতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অত্যন্ত সম্মানিত একজন ব্যক্তি। তাই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ বর্ধিত শুল্কারোপ করেছে কোনো কোনো দেশের পণ্যের ওপর। বাংলাদেশ যদি সেই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে।

শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর করে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদের রপ্তানি পণ্য তালিকায় নতুন নতুন পণ্যের উপস্থিতি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য আরও বাড়াতে হবে। কারও দয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকার সুযোগ নেই। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ