ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত শুধু কাগজ-কলমে
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি!
অতি সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহতের ঘটনায় দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ভবন নির্মাণে নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। তা ছাড়া যখন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ধস কিংবা আগুন লাগে, তখন বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচিত হয় এবং একসময় আবার আলোচনা থেমে যায়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তারপর ঝুঁকির মধ্যেই আগের মতো চলতে থাকে বসবাস, পাঠদান, অফিস ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম। বিচ্ছিন্ন করা হয় না ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন সংযোগ। বাতিল হয় না হোল্ডিং নম্বর। ফলে আগুন লাগা কিংবা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ হলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেরিয়ে আসছে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন নির্মাণের নানা অনিয়ম। আটতলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনে ছিল না রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন। অথচ প্রায় প্রতিটি তলাতেই ধুমধামে চলেছে নামিদামি আটটি রেস্টুরেন্ট। শুধু তাই নয়, যে ২২ শর্তে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছিল, তার একটিও কেউ অনুসরণ করেনি ভাবন কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তিন দফায় এসব নিয়ে নোটিশ দিলেও আমলে নেননি ভবন মালিকরা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেবল বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন নয়, ঢাকা শহরে এ রকম হাজার হাজার ভবন রয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটার পরই আমরা জানতে পারি, সেখানে কী কী ত্রুটি বা দুর্বলতা ছিল। আর যে কোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, বিস্ফোরণ, নর্দমায় মানুষ পড়ে মৃত্যুসহ যেকোনো দুর্যোগে প্রথমে ছুটে যান ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা; কিন্তু নগরে এসব কাজের সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত; কিন্তু তাদের তেমন দেখা মেলে না। বাস্তবে এ ধরনের কোনো কার্যকর কাঠামোই নেই ঢাকায়। যদিও ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কেমন হবে আইনে তা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। অথচ ভবন মালিকরা জেনেবুঝেও তা মানছেন না। যত্রতত্র রাখা হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না ফিটনেস। আবাসিক ভবনে কেমিক্যাল রাখা বন্ধ হয়নি। ওদিকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোও ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ঘুষের বিনিময়ে সবকিছু জায়েজ করে দেয়ার গুরুতর অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীসহ দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান কোনো মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের সহযোগী দুই সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশনের তথ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যার বিস্তর অমিল। অবশ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কেন ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোগুলো অপসারণ করা হচ্ছে না।
আবার শুধু বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে কেন? তখন তাদের পরিদর্শন, প্রতিশ্রুতি কিংবা আশ্বাস দুর্ঘটনা ঠেকাতে কতটা ভূমিকা রাখে, সেটাও এখন খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। বিশেষ করে রাজউক বা সিটি করপোরেশন, যাদের এসব ভবন নজরদারি করার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, ভবন মালিকদের কাছ থেকে নানারকম সুবিধা নিয়ে তারাই এসব অনিয়মের প্রশ্রয় দেন। আরও অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে নির্মিত ভবনের অনেকই মালিক আর্থিক বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সে ক্ষেত্রে এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা কতটা সম্ভব হবে!
সূত্র বলছে, রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে এ মামলা করেছে। সেই মামলায় কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, এখানেই শুভংকরের ফাঁকি। কারণ এই মামলায় রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কোনো অসাধু কর্মকর্তার নেই। আমরা মনে করি, তাদের সহযোগিতা ছাড়া অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব। আর তা না হলে তাদের দায়িত্বে অবহেলা আছে।
তাই ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড আইন’ থাকলেও এর বাস্তবায়ন এখন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইনের মুখোমুখি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখনই মোক্ষম সময়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে