Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মিয়ানমার সীমান্তের উদ্বেগ কাটিয়ে বাংলাদেশ কি ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে মোকাবিলা করতে পারবে?

Simon Mohsin

সাইমন মোহসিন

বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

০২৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে মিয়ানমারে চলছে নাটকীয় সংঘাত-বিদ্রোহ। একে যুদ্ধ বলাই শ্রেয়। এর মূল ফোকাস এখন রাখাইন প্রদেশের দিকে। আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। এটা শুধু ময়ানমারের জান্তা বাহিনীর জন্য ঝুঁকি বাড়ায়নি, পুরো অঞ্চলটাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আরাকান বাহিনী যদি বঙ্গোপসার এবং মিয়ানমারের কেন্দ্রস্থলের মধ্যে রাখাইন প্রদেশে নিশ্চিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে তা সামরিক বাহিনীর রাজ্য প্রশাসন পরিষদ (এসএসি)-কে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।

ত্রিপক্ষীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গড়ে ওঠা জোট আরাকান আর্র্মি। নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে তারা শান প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। গত এক দশকে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন প্রদেশের প্রশাসনেও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তৃত করেছে। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের ক্ষমতা দখলের ২ বছর পূর্তি করেছে। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিল। এরপর থেকে দেশটিতে চলছে চরম অস্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ ভঙ্গুর। গৃহযুদ্ধ চলছে। মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর ওপর সামরিক প্রশাসনের শাসন জেঁকে বসেছে। সামরিক শাসন থেকে জাতিটির মুক্তি দরকার; কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। এর জন্য লড়াই চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মিলে সশস্ত্র বিপ্লবী দল গড়ে তুলেছে। তারা একযোগে লড়াই করছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। কোথাও কোথাও তারা জনসমর্থনও পাচ্ছে। জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে এই বিপ্লবীগোষ্ঠীগুলো এখন এক হয়ে যাচ্ছে।


স্টিমসন সেন্টারের বিশ্লেষণ অনুসারে, আরাকান আর্মির কার্যক্রম সংক্ষেপে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: রাখাইনে জান্তার সঙ্গে ক্ষমতা দখলের লড়াই, জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অন্যান্য জাতিগত মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা, অভ্যুত্থানের পর প্রতিরোধ বাহিনীকে সহায়তা এবং জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। রাখাইন প্রদেশে জান্তা বাহিনীর সম্পূর্ণ পতন হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক অধিকার, শাসন ও ক্ষমতা-কাঠামোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত আরাকান আর্মি থামবে না বলেই তাদের কার্যক্রমে বোঝা যাচ্ছে।

রাখাইনের সংঘাত এখন আন্তঃআঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাখাইন ইস্যুতে এখন ভারত, চীন নাক গলাচ্ছে। উভয় দেশেরই এ ব্যাপারে কৌশলগত স্বার্থ আছে। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে দুটি আঞ্চলিক পরাশক্তিরই মাথাব্যথা। (যদিও কীভাবে এবং কারা যে এই অঞ্চলটি অস্থিতিশীল করে তুলেছে তাও বিতর্কের বিষয়।) ভারতের জন্য পশ্চিম মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পালেতোয়া কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে এর অবস্থান মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। ভারতের পূর্বাঞ্চলী ভূ-রাজনীতির জন্য এই স্থানটি ঘূর্ণন চাকা হয়ে কাজ করে। এখানে ভারতের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। অসংখ্য অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। বিশেষত কালাদান সড়ক প্রকল্প বা কালাদান মাল্টি-মডেল পরিবহন প্রকল্পের কথা বলতে হয়। ২০০৮ সালে এ প্রকল্প শুরু হয়েছিল সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) সরকারের সঙ্গে। এটি উচ্চাভিলাষী দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পের একটি অংশ। বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে এখানে। হুগলির কলকাতা বন্দরকে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করার মহাপরিকল্পনা এটি। মিয়ানমারের চীন প্রদেশকে অবকাঠামোগতভাবে সম্প্রসারণ করাই ভারতের একমাত্র লক্ষ্য নয়, পাশাপাশি নিজেদের যোগাযোগ ও বাণিজ্যপথকে আরও সুদূরপ্রসারী করাও তাদের উদ্দেশ্য। ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর অপেক্ষাকৃত দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা। কালাদান প্রকল্প হয়ে গেলে এদিকের যোগাযোগ-ব্যবস্থাও উন্নত হয়ে যাবে। সাধারণভাবে যাকে বলা হয় মুরগির গলা, ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রদেশে যোগাযোগের দূরত্ব এতে স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। তখন তারা প্রয়োজনীয় কৌশলগত উদ্যোগ নিতে পারবে অনায়াসে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকার একটি রেলওয়ে প্রকল্প চালু করেছে, এই প্রকল্পের আওতায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হচ্ছে, যা ভারতকে দক্ষিণ ত্রিপুরার সঙ্গে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগের সুবিধা দিবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোও সঙ্গে ভারত এই পথে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে। ভ্রাতৃমৈত্রীর অংশ হিসেবে এনইউজির সশস্ত্র শাখাটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরাকান আর্মি ভারত, চীন, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি শহর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি আরাকান আর্মি পালেতোয়া দখল নেয়। এর জন্য ভারতীয় সেনারা এখন আরাকান আর্মিদের কঠিন নজরদারিতে রেখেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা, আরাকান আর্মি এখন ভারত ও চীনের দিকেও অগ্রসর হচ্ছে। কিছুদিন আগে আরাকান আর্মি ভারতনির্ভর কালাদান প্রকল্পে আক্রমণ করেছে; কিন্তু, চীনের বৃহৎ প্রকল্পগুলো এরা কখনো স্পর্শ করেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আরাকান আর্মি অনেকটা চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেই কাজ করছে।

মিয়ানমারের কিয়াকপিউতে চীন বিশেষ অর্থনীতি জোনে (এসইজেড) অর্থায়ন করেছে। এসইজেড বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সিউ গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চীনের উনানের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করবে। মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে ওই অংশের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য রেলপথ তৈরি করছে চীনও। সীমান্ত অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য চীন মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এমন কিছু বিশ্লেষণ বেরিয়েছে যে বিজয়ী যেই হোক, উভয় পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চীনের আছে। কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই এ-কথা বলা যায়, শাসক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই এখন চীন ও ভারতের কৌশলগত লক্ষ্য।

মিয়ানমারের হতভাগ্য অবাঞ্ছিত শিশুদের লালন-পালন করা ছাড়া বাংলাদেশের আর কিছুই করার নেই। বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে মিয়ানমারের জান্তা, ভারত, চীন আর ভ্রাতৃত্ব মৈত্রী অথবা আরাকান আর্মির স্বার্থের ফাঁদে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় জান্তার সঙ্গে দেন-দরবারে বাংলাদেশ এখনো তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। যা হতে পারতো এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধানকারী, যারা বস্তুত এই খেলা পেতেছে, সেই চীনের কাছ থেকেও এই ইস্যুতে কোনো প্রতিশ্রুতি ও সমর্থন পাওয়া যায়নি। ভারত থেকেও শোনা যায়নি কোনো আশার বাণী, অথচ তারা এই খেলা থেকে সবচেয়ে দক্ষভাবে দূরে সরে আছে। ভারত কী খেলছে না খেলা দেখছে তাও বোঝা যাচ্ছে না।

এই আঞ্চলিক লাভগুলো নিশ্চিত করছে দীর্ঘদিন আরাকান আর্মির রাখাইন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য। তবে, তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারও করতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশ-দীর্ঘদিন ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু, নজরে রেখেছে। ফ্রন্টিয়ারের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ এবং আরাকান আর্মির মধ্যে কয়েক বছর ধরে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে। এই যোগাযোগ হয়েছে মাঠ পর্যায়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ সম্পর্কে ‘খুব অল্পই ধারণা আছে’ বলতে গেলে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মির একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার নিশ্চিত করেছেন তাদের মধ্যে সংলাপ বিনিময় হয়েছে। সীমান্তের কাছে সংঘাত চলাতে বাংলাদেশ সরকার আগের বছরের তুলনায় এখন বেশি উদ্বিগ্ন। সীমান্তের কাছাকাছি লড়াই চলছে, এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে জড়িত থকার সত্যতা প্রমাণ হওয়াতে বাংলাদেশ এখন যথাযথই চিন্তিত। ওই অঞ্চলে লড়াই-সংঘাতের ফলে বাংলাদেশ সীমান্তেরও কিছু লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মর্টার শেল সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের সীমানায় এসে পড়েছে। মিয়ানমার সীমান্তের দায়িত্বরত অফিসাররাও এখন নিরাপত্তার জন্য যখন-তখন বাংলাদেশে ঢুকে যাচ্ছেন। এই সমস্যাগুলো এমন এক জায়গায় দেখা দিয়েছে যেখানে বাংলাদেশেরও আভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা রয়েছে। পুরোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে নতুন জঙ্গিবাহিনী। ফলে সমস্যা এখন প্রকটই হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ঝুঁকি এখন সব দিক দিয়েই বাড়ছে। নিজস্ব সমস্যার পাশাপাশি আঞ্চলিক সমস্যাও বাংলাদেশকে এখন মোকাবিলা করতে হবে। প্রতি মুহূর্তেই বাংলাদেশ এখন নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মধ্যে আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্রোহী-বিক্ষোভকারী-প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত না হয়ে বাংলাদেশ এখনো মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গেই সম্পর্ক রক্ষায় প্রাধান্য দিচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর ২০২১ সাল থেকে যারা ক্ষমতায় আছে। কিন্তু, জান্তা এই সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলেই এখন আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগসাজশের উন্মোচিত হচ্ছে। আরাকান আর্মি কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চেয়ে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।

রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি এবং শাসন কাঠামোতে যদি কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত অংশের সঙ্গে থাকবে বলেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য সাক্ষ্য দেয়। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাবই বাংলাদেশের তালিকার শীর্ষে থাকবে। যখন এমন একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যপথে আরও কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্যভাবে বাংলাদেশের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। বঙ্গোপসারই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সমুদ্রপথ, যে-পথ এই উপকূলের সবাই নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে। বছরে এই পথ দিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈশ্বিক বাণিজ্য হচ্ছে। সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশ আছে এর কেন্দ্রীয় অবস্থানে। কৌশলগত দিক দিয়ে বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো অবস্থানে। এই উপকূলের ১৩টি বন্দরের মধ্যে বাংলাদেশেই চারটি, একটি গভীর সমুদ্র বন্দরসহ। এই দৃশ্যমান সংকটকে বাংলাদেশের সুযোগে রূপ দেয়া উচিত।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ