পরিবেশ রক্ষায় সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করব
বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর কোথাও পরিবর্তনের যাত্রা খুব সহজ হয় না। আমি জানি অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, যা আমি আগেও করেছি। আমাদের দেশে যেখানে আইনের শাসনের ইন্ডিকেটর খুবই নিচের দিকে, সেখানে এটা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু এই ঝুঁকিটা আমরা অতিক্রম করতে পারব, কারণ আমাদের সঙ্গে সমাজের মূল ধারার জনগোষ্ঠী আছে। বড় জনগোষ্ঠী এবং মূল ধারার মিডিয়ার সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলও আমাদের ওপর নজর রাখে। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি দিয়েই আমরা ঝুঁকিগুলোর মোকাবিলা করতে চাই। বিভিন্ন প্রকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করাই আমার লক্ষ্য। পরিবেশ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে অধিকতর জনবান্ধব মন্ত্রণালয়ে পরিণত করা হবে। নদীদূষণ রোধের কাজ হয়তো পুরোটা পারব না। তবে অতিদূষণ যেসব নদী আছে, সেগুলো গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে কাজ করব।
জাতীয় ঐতিহ্যবাহী বিল ও নদীগুলোর অবৈধ দখলরোধে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এর অংশ হিসেবে আড়িয়ল, চলন, বেলাই ও বসিলা বিলের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করব। গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টাসহ চলতি আগস্ট মাসের শেষের দিকে আড়িয়ল বিল পরিদর্শনে যাব। এ ছাড়া ফসলের ক্ষতি কমাতে হাওর এলাকায় যথাসময়ে বাঁধ মেরামত করার উদ্যোগ নেয়া হবে। যারা কয়লা, গ্যাস, জমি জলাশয়ের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায় বা এগুলোকে দূষিত করে ধ্বংস করে নিজেদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। মানুষের পানির অধিকার নিশ্চিত করতে নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ দ্রুতই শুরু করব। বুড়িগঙ্গা, বালু, বড়াল, পিয়াইন, ডাউকি, সোমেশ্বরী, মগড়া এবং করতোয়াসহ সংকটাপন্ন নদীর তালিকা প্রস্তুত করে সেখান থেকে ক্ষতিকর স্থাপনা সরিয়ে দিতে হবে।
নদীর বালু এবং পাথর উত্তোলনকে নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা তৈরি করব। পলিথিনের ব্যাবহার বন্ধ করব। নদীভাঙন রোধে প্রচেষ্টা জোরদারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করা হবে। কোনো কর্মকর্তা কর্তব্য পালনকালে কোনো দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবহেলা করলে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুশাসন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় মানুষের তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করব মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদেরও সম্পৃক্ত করার চিন্তা করছি। বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে শিগগিরই বসব। আমাদের সময় দিতে হবে। এক দিনে সব করা সম্ভব না। সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়েই কাজ করব। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো চিহ্নিত করে সেখানে কাজ করব। দেশে নির্মল বাতাস ফিরিয়ে আনা আমার মূল লক্ষ্য। সব অনিয়ম দূর করে দেশের বন রক্ষায় কাজ করব।
আমি সারা জীবন পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেছি। আইনি লড়াই করেছি। এখন আমি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাই আমি আমার সর্বোশক্তি দিয়ে এই সেক্টরে কাজ করব। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাপ্ত বিদেশি অর্থ সর্বোচ্চ সঠিক জায়গায় ব্যাবহার করব। পরিবেশ ধ্বংসকারী চিহ্নিতদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। অবৈধ ইটভাটা চলতে দেব না। শিগগিরই অভিযান শুরু হবে। পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, গাড়ির হর্নজনিত শব্দদূষণ বন্ধ, নদীদূষণ রোধে উদ্যোগ গ্রহণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উন্নয়ন, পাহাড় রক্ষা, বন সংরক্ষণ, জলাশয় ভরাট রোধসহ পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করব।
সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মন্ত্রণালয়ের কাজে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা, সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, প্রাইভেট সেক্টর, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ অন্যদের সঙ্গে জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করা হবে। পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে নিয়মিত জাতীয় পরিবেশ কমিটির সভা আহ্বান করব। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তগুলো নিয়মিত ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা হবে। রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প কারখানাগুলো স্থানান্তরিত হওয়ায় কিছুটা হলেও দূষণ কমেছে ঢাকার প্রাণ হিসেবে পরিচিতি বুড়িগঙ্গা নদীর। তবে এই স্থানান্তর অত সহজ ছিল না। দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াইয়ের ফলে এই সাফল্য আসে। এটা ধরে রাখতে হবে।
জনস্বার্থে সরকারের যে কাজ করা উচিত, সেটা না করলে আমরা মামলা করি। এখন দেখা যাচ্ছে বিদেশি অর্থায়নে সরকার যে কাজ করছে, কখনো কখনো সেটাও জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমরা মামলা করছি। এসব করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। এ মামলা করতে গিয়ে যারা ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তাদের রক্ষায় হেভিয়াস কর্পাস মামলাও করতে হয়। যারা জনস্বার্থে মামলা করে, তাদের দেখতে হয় পাবলিক স্পিরিট ঠিক আছে কি না। অনেক মামলা করতে হলে যথেষ্ট গবেষণা করতে হয়। এই গবেষণার জন্য বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরাও অর্থায়ন করে। নারী অধিকার, পাহাড় রক্ষা, পাথর উত্তোলন, বন্যপ্রাণী রক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ, ভূমি অধিকার, শিশু অধিকারসহ অনেক বিষয় নিয়ে মামলা হচ্ছে।
আমরা বেলা থেকে একটা মামলা করেছিলাম, যে মামলায় নির্দেশ দেওয়া হলো ট্যানারিকে হাজারীবাগ থেকে ধলেশ্বরীতে সরিয়ে নেওয়া হবে। ওই মামলার পর অনেক আদেশ হয়েছে। কারণ, ধলেশ্বরীতে গিয়েও ওরা একই কাজ করছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য সংশোধনাগার (সিইটিপি) প্রস্তুত না থাকার জন্য ২০০৯ সালে রায় পাওয়ার পরও আমাদের ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে। আজ সিইটিপি প্রস্তুত, কিন্তু সেটা চালু হচ্ছে না। এই বিষয়টি সমাধান করতে হবে। জনস্বার্থের একটা কাজ যখন দীর্ঘদিন থেমে থাকে, তখনই আমাদের আদালতে যেতে হয়; কিন্তু আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত অন্যায় যেন না হয়, সে জন্য কাজ করা। এখন তথ্য অধিকার আইন আছে; কিন্তু যখন তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যাই, তাদের কাছ থেকে সব সময় সঠিকভাবে তথ্য পাই না। এটা যেন আর না হয় সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। সবাই মিলে দেশের মাটি, পানি আর বাতাসকে ভালো রাখতে হবে। তাবেই দেশ ও দেশের মানুষ ভালো থাকবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে