Views Bangladesh Logo

টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত

বিগত সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতি সত্যিই কি উদ্ঘাটিত হবে?

Rased Mehedi

রাশেদ মেহেদী

বাংলাদেশের তথ্য ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বিগত ১৫ বছরে কি ঘটেছে, কতটা দুর্নীতি হয়েছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর। সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অনিয়মের চিত্র যা পেয়েছি তা রিপোর্ট করেছি; কিন্তু পতিত সরকারের আমলে সাংবাদিকদের জন্য অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়াও সহজ ছিল না। সম্ভবত, বিগত সময়ের সেই তথ্য পাওয়ার সেই চ্যালেঞ্জের মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরাও পড়েছেন। যে কারণে মুখে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক অভিযোগ তুললেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য খুব কমই জনগণের সামনে এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ বর্তমান সরকারের আমলে তদন্ত কমিটি হয়েছে। দু-একটি কমিটি রিপোর্টও দিয়েছে; কিন্তু সেই কমিটির রিপোর্ট জনগণের সামনে আসেনি।

যেমন পেশাগত দায়িত্বপালনের অংশ হিসেবেই খোঁজ নিতে গিয়ে আমি জেনেছি বিগত সরকারের আমলে বিটিসিএলের ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পে অনিয়ম নিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটি গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। রিপোর্টে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক একজন সচিব (পদাধিকার বলে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন) তার বিরেুদ্ধে অনিয়মের সরাসারি প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে। দুটি বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে অনিয়মের মাধ্যমে প্রভাবিত করা এবং সাবেক এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের তথ্য উঠেছে। আমার প্রত্যাশা ছিল, সেই তদন্ত রিপোর্ট সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করা হবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে; কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট সামনে আসেনি। টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অনিয়ম নিয়ে ভাসা ভাসা তথ্যের ওপর নির্ভর করে ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট(!) করা দু-একজন সাংবাদিক-ব্লগার, যারা রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন, তাদেরও এই তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কোনো রিপোর্ট করতে দেখিনি।

অথচ এই ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের টেন্ডারে গুরুতর অনিয়ম নিয়ে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই দেশের তিনটি জাতীয় দৈনিকে বিস্তারিত রিপোর্ট হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে আসা অনিয়মের তথ্যের সঙ্গে সেই জাতীয় দৈনিকগুলোর রিপোর্টের তথ্যের প্রায় পুরোপুরি মিল রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়, পতিত সরকারে আমলেও সংখ্যায় কম হলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেছেন দেশে থেকেই দায়িত্ব পালন করা পেশাদার সাংবাদিকরা। তারা সঠিকভাবেই অনিয়মের চিত্র তুলে এনেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে পতিত সরকারের আমলেও ফাইভ জি রেডিনেস প্রকল্পের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও এক অর্থে তদন্ত রিপোর্টটি আড়ালে রেখে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে!

আসলে প্রথমে জানা দরকার টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কীভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। দীর্ঘদিনের পেশাগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি টেলিযোগাযোগ খাতে অনিয়ম হয় এ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন প্রকল্প ঘিরে। এর মধ্যে বিটিসিএল, টেলিটক এবং সাবমেরিন কেবল কোম্পানির অনিয়মের খবর বিগত সময়ে বেশি শিরোনাম হয়েছে। মনে রাখতে হবে পদাধিকার বলে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবরা। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর প্রকল্প ঘিরে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগও বেশি থাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সচিবেরই। বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে সুযোগ থাকে যদি তিনি সচিবের সঙ্গে সহযোগী হন। তবে বিগত সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রী-সচিবের দ্বন্দ্বই প্রকট হতে দেখা গেছে। এর মূল কারণও ছিল সেই প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। ফাইভ জি রেডিনেস প্রকল্পের তদন্তে রিপোর্ট থেকে টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে নেয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং অনিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

টেলিযোগাযোগ খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কার্যক্রমের ভেতরেও অনিয়মের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিগত সময়ে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে ছিল বিটিআরসি। সেই প্রকল্প ঘিরে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে এবং প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দেয়া হয়। এই বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্প ঘিরে তদন্ত হলে পতিত সরকারের আমলে কারা কীভাবে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার একটা চিত্র পাওয়া সম্ভব। সেই কর্তা-ব্যক্তিদের এখন কে কোথায় কোন দায়িত্বে আছেন, তাও জানা সম্ভব। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট প্রকল্প মাঝপথে মুখথুবড়ে পড়েছে। তদন্ত করলে কেন মুখথুবড়ে পড়েছে, সে সম্পর্কেও চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটিআরসির এনইআইআর (ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্ট্রার) সার্ভার স্থাপন করার পর সেটা কেন অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকল, সে বিষয়টিও তদন্তে এলে বিটিআরসির প্রকল্প ঘিরে সে সময় কি ঘটেছিল, তা জানা সম্ভব হতো এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপচয় রোধে পরিকল্পনা গ্রহণও সহজ হতো।

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে অনিয়মের ধরন একটু আলাদা। এখানে যে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বে থাকেন, তিনিই বিভাগের সর্বেসর্বা। যে কারণে এই বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতিতেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসারি নিয়ন্ত্রণ থাকে। বিগত সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে অনিয়মের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া যায় তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি, প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প ঘিরে। একবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একজন সংসদ সদস্য অভিযোগ করেছিলেন, ‘লার্নিং-আর্নিং’ প্রকল্পের আওতায় তার এলাকায় প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে যাদের নাম তালিকায় এসেছে তাদের অধিকাংশকেই তিনি চেনেন না। সংসদীয় কমিটির সভায় গলা চড়ালেও পরে অবশ্য সেই সংসদ সদস্য নিজের অভিযোগ সম্পর্কেই সাংবাদিকদের আর বিস্তারিত জানাতে চাননি।এ বিভাগে প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা তৈরির নামে এ ধরনের অসংখ্য প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলো থেকে জাতি কার্যত সুফল পায়নি।

আবার তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার নির্মাণ করা হয়। এই ডাটা সেন্টার তৈরির সময় বলা হয়েছিল, এটি স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বড় বড় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর কোলোকেটেড কনটেন্ট ডেলিভারি সার্ভার বসবে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ডাটা সুরক্ষিত থাকবে; কিন্তু বাস্তবে এই ডাটা সেন্টারটিতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কিছু ডাটা সংরক্ষণের বাইরে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক কোনো প্রতিষ্ঠানই আসেনি। কারণ এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এ ধরনের একটি ডাটা সেন্টারে আত্মীয়করণের মাধ্যমে বড় সংখ্যায় অদক্ষ জনবল নিয়োগের অভিযোগও উঠেছে। তদন্ত হলে এই তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে ‘প্রকল্প প্রকল্প’ খেলায় কী ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির মহড়া হয়েছে, সে সম্পর্কে জানা যেত; কিন্তু সে ধরনের তদন্তের উদ্যোগ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।

আসলে টেলিযোগাযোগ খাত কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি খাত, সবক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে আমলা-ব্যবসায়ী একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে সব সময়, সব সরকারের আমলে। যারা দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন, তারা চোখের সামনে দেখেছেন কীভাবে বিএনপি আমলের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে। আবার পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট এখন কীভাবে আবারও সুবিধাভোগীর চরিত্রেই থেকে যাচ্ছে। আর সুবিধাভোগী চক্র মোটামুটি একই থাকার কারণে সবাই বিগত সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির যতটা সম্ভব চাপা দিয়ে রাখতেই চায়। যে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যথাযথ তদন্ত হয় না। আবার তদন্ত হলে সেই রিপোর্টও আড়ালেই থেকে যায়।

পেশাগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই সিন্ডিকেট নতুন নতুন বাহারি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। পুরোনো প্রকল্প, পুরোনো রূপরেখা কীভাবে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করতে হয়, এরা খুবই ভালো জানে। নতুন প্রকল্প আসলেই আবারও নতুন করে বাজেট বরাদ্দ। আবারও পকেট ভরার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। বর্তমান সরকারের আমলেও তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটাই প্রত্যাশা; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিগত সময়ে সুবিধাভোগীদের এ আমলেও ভোল পাল্টে ‘কট্টর আওয়ামীবিরোধী’ সেজে পুরোনো খেলা নতুন করে খেলার তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। বিগত সময়ে ‘সব কাজ একেবারে খারাপ হয়েছে, সবকিছুই নষ্ট ছিল’- এই কলরবে মুখর হয়ে পুরোনো কায়দায় নতুন প্রকল্প খাওয়ানোর খেলায় তারা নানাভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, বিগত সময়ে সবকিছুই খুব খারাপ হয়েছে, সেটা ঠিক নয়। যদি বিগত সময়ে সারা দেশে উপযুক্ত টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে না উঠত, তাহলে আজ দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ফোর জি সেবা কীভাবে চলছে? বিগত সময়ে সব খারাপ হলে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের এই বিপুল ব্যবহার, চাহিদা কীভাবে তৈরি হতো? কভিড-১৯ মহামারির সময়ে এক লাফে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার পরও ব্যান্ডউইথ সরবরাহে ঘাটতি হয়নি। কমন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি ইন্টারনেট সেবাদাতা উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। বিগত সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি যেটুকু অর্জন, সেটাকেও অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।এখানেই বর্তমান সরকারের যথাযথ পর্যবেক্ষণ দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্ঘাটনের পাশাপাশি বিগত সময়ে কোন প্রকল্প থেকে জনগণ কতটা সুফল পেয়েছে কিংবা পায়নি, তা নিরূপণ করা দরকার। সেই আলোকে শুধু একান্ত প্রয়োজন বিবেচনায় নতুন প্রকল্প নিলে সেটাই সরকারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে, জনগণ সুফল পাবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ও বন্ধ হবে।

রাশেদ মেহেদী: টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশ্লেষক এবং সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ