সিন্ডিকেটের চক্কর থেকে কি গবাদি পশুখাদ্য বাদ যাবে না
বাংলাদেশ এক আজব দেশ। সুযোগ পেলেই যেখানে একটি চক্র খাদ্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। রোজার ঈদ সামনে রেখে বাড়ে মানুষের খাদ্যের দাম, আর কোরবানি ঈদ সামনে রেখে বাড়ছে গবাদি পশুখাদ্যের দাম। ডাল-তেল-খেজুরের মতো সিন্ডেকেটের চক্কর থেকে রেহাই পাচ্ছে না গমের ভুসি, ধানের কুঁড়া, সয়ামিল, ডি-অয়েল রাইস পলিশ, মসুর ভুসি, সরিষার খৈল, ভুট্টা, ছোলার ভুসি, মুগ ভুসি, খড়, চালের খুদ। ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন) বলছে, এক বছরেই প্রাণীর খাবারের দাম বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, যেখানে বিশ্ববাজারে বাড়ে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।
গতকাল রোববার (১২ মে) সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, প্রাণিখাদ্যের দামের যে বল্গা ছুটেছে, তাতে ডেইরি কিংবা পোলট্রি খাতের বিনিয়োগ থেকে পিছু হটছেন অনেক উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র খামারি। দেশের বাজারে গেল এক বছরে প্রাণিখাদ্যের দাম যেভাবে আস্ফালন দেখাচ্ছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! দফায় দফায় দাম বাড়ায় এরই মধ্যে দেশের কয়েকশ খামারি তল্পিতল্পা গুটিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাণিখাদ্যের দাম বাড়ার এ কারসাজিতে তাল দিচ্ছে শক্তিশালী চক্র (সিন্ডিকেট)। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এ চক্র হয়ে উঠেছে আরও ক্রিয়াশীল। বাজার খেয়ালখুশিমতো চালাতে গো-খাদ্য মজুত রেখে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। মানবখাদ্যের দাম নির্ধারণ, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রাণিখাদ্যের দামের সিন্ডিকেটের কলকাঠি দমাতে নেই কেউ।
শুধু যে দাম বাড়ছে তাই নয়, অনুমোদনহীন নিম্নমানের ভেজাল গো-খাদ্যে ও পোলট্রি ফিড তৈরিরও অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এসব খাদ্যে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখসহ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্যও থাকে না। আবার কখনো কখনো প্যাকেটে নামিদামি কোম্পানির নাম ব্যবহার করে খামারিদের চোখ ফাঁকি দিচ্ছে অসাধু চক্র। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল প্রাণিখাদ্য তৈরির সন্ধান পাওয়া যায়। পরে জরিমানাসহ সংশ্লিষ্ট কারখানা সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
প্রাণিখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক খামারি বাধ্য হয়ে গবাদি পশুকে নিম্নমানের খাবার খাওয়ান। সেই গবাদি পশু তো শেষ পর্যন্ত মানুষের উদরেই যাবে। ফলে ওই নিম্নমানের খাদ্যের ভাগীদার মানুষই হবে। এতে মানুষও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। নিম্নমানের খাবার গ্রহণের ফলে অনেক পশুও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক পশু মারাও যাচ্ছে।
মানুষ ও প্রাণীর খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেক দিন ধরেই অনেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরিস্থতিকে দায়ী করছেন; কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে আর কোনো দেশ এত দ্রুত কোনো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়েনি, যা বেড়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে সবাই দায়ী করছেন সিন্ডিকেটকেই। দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক সময় মাঠে-পথে নামেন; কিন্তু দিন শেষে অরাজক পরিস্থিতি যেমন- তেমনিই থাকে। অনেকেই বলছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা আসলে মানুষকে একটা সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই না।
এভাবে চলতে থাকলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি কতটা হুমকির মধ্যে পড়বে তা কি আমাদের হিসাব আছে? ডেইরি ও পোলট্রি ফার্মগুলো বন্ধ হয়ে গেল শুধু যে খাদ্যঘাটতি, পুষ্টিঘাতটি হবে, তা নয়, অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের ওপর অধিক চাপ পড়বে। বাধ্য হয়ে তখন খাদ্য-আমদানি বাড়াতে হবে। দেশের খামারিরা এতে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিন্ডিকেটের ফলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাভবান হয়; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজার হাজার নিম্ন-আয়ের মানুষ। অনেককে পথে বসতে হয়। একটি অপরাধের ফলে কত ধরনের সমস্যা হচ্ছে তা একটু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার অনুরোধ করি। আমাদের জীবনের সবকিছুই এখন চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে রেহাই না পেলে এ দেশের মানুষও বাঁচবে না, পশুও বাঁচবে না। সরকার যদি এখনই এদিকে দৃষ্টি না দেয় তাহলে সামনে সমূহ বিপদ। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি তদারকি করে আশু সমাধান নিশ্চিত করবেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে