জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাকিব কি বদলে যাবেন?
ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আপনি পছন্দ করতে পারেন কিংবা নাও করতে পারেন। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের কথা ভাবতে পারা যায় না। কীভাবে যাবে? সাফল্যের দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে তার মতো আর কে বাংলাদেশকে গর্বিত করেছেন? বাংলাদেশ যে কোনো বিষয়ে বিশ্বসেরা হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। ব্যাট ও বলে চমকপ্রদ কৃতিত্ব দেখিয়ে হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। এমন কীর্তি অভাবিত ও অবিশ্বাস্য হলেও সহজাত প্রতিভার অধিকারী সাকিবের কাছে এই মাইলফলক অর্জন খুবই স্বাভাবিক মনে হওয়ারই কথা। এর কারণ, খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য যে চাবিকাঠি তার করায়ত্ত হয়েছে, চাইলেই যেন তিনি তা ইচ্ছে অনুসারে পরিচালন করতে পারেন। বিষয়টি অতিশয়োক্তি মনে হলেও যেভাবে তার উত্থান ঘটেছে, তাতে এমনটি ভাবায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আসলে মাঠে আর মাঠের বাইরের সাকিবকে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। এমনিতে তাকে খুবই সাদামাটা লাগলেও মাঠে নামলে তিনি যেন হয়ে যান রীতিমতো ম্যাজিসিয়ান। তার জাদুর উপকরণ ব্যাট আর বল। তা দিয়ে এমন সব ইন্দ্রজাল দেখিয়ে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেন, সত্যিই তার কোনো তুলনা হয় না। দুনিয়া কাঁপানো ক্রিকেটারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল করেছেন নিজেকে। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য রেকর্ড আর সাফল্যের গল্প। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থানকে সমীহযোগ্য করার ক্ষেত্রে তার অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। যদিও ভিন্ন ভিন্ন খেলার সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না, তদুপরি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে তাকে সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এ নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে; কিন্তু একদমই উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ‘ব্র্যান্ড নেম’-এ পরিণত হয়েছেন সাকিব আল হাসান।
ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন, নন্দিত হয়েছেন; কিন্তু কিছু কিছু ঘটনায় যথেষ্ট নিন্দিতও হয়েছেন। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, খ্যাতির কিছু বিড়ম্বনা আছে। যে যত জনপ্রিয়, আনুপাতিক হারে তার বিড়ম্বনাও তত বেশি। এই বিড়ম্বনা সামাল দেয়া মোটেও সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে কৌশল ও দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে। কেউ কেউ এই বিড়ম্বনা উপভোগ করেন, আবার অনেকেই বিরক্ত হন। এর প্রকাশটা ঘটে এক এক জনের এক এক কায়দায়। সাকিবের প্রকাশভঙ্গি নানান আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এ কারণে বিতর্ক যেন সাকিবের পিছু ছাড়তে চায় না।
১৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাঠে এবং মাঠের বাইরে তাকে কেন্দ্র করে অসংখ্যবার তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। দর্শক, ভক্ত, অনুরাগী, ক্রিকেটার, আম্পায়ার, সংগঠকদের সঙ্গে তার দৃষ্টিকটূ আচরণ ও ব্যবহারে অনেকেই মর্মাহত হয়েছেন। কষ্ট পেয়েছেন। তিনি মেজাজ হারিয়ে এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা তার ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যদিও তিনি তার তোয়াক্কা করেন না। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ‘পোস্টার-বয়’ হওয়ার কারণে তাকে নিয়ে সবারই অন্তহীন কৌতূহল। তার নিউজ ভ্যালুও অনেক বেশি। সঙ্গত কারণেই পান থেকে চুন খসলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো বটেই ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়ায় মুহূর্তেই তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এটা জানার পরও সাকিব হয় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না নতুবা নিয়ন্ত্রণ করার তাগিদ অনুভব করেন না। হতে পারে বিতর্ক, সমালোচনা কিংবা ঘটনাবলি তিনি উপভোগ করেন।
এ যাবৎ কতভাবেই না তিনি আলোচনায় উঠে এসেছেন। ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটিং করার সময় সাইড স্ক্রিনের পাশে এক দর্শকের নড়াচড়ায় রেগে যান। সাকিব ক্রিজ ছেড়ে বাউন্ডারি লাইনে ছুটে গিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করার পাশাপাশি ব্যাট উঁচিয়ে অভিযুক্ত দর্শককে হুমকি দেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের শোচনীয় ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর দর্শকরা তাকে দুয়ো দেন। জবাবে তিনি মধ্যমা আঙুল দেখিয়ে বাজে ইঙ্গিত করেন। ২০১৩ সালে একজন অনুরাগী অটোগ্রাফ চাইলে তিনি দিতে অস্বীকৃতি জানান। অটোগ্রাফ না পেয়ে কটূক্তি করলে সাকিব গ্যালারিতে গিয়ে তার কলার চেপে ধরেন। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ছক্কা মারতে গিয়ে লংঅনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসেন। সেই আউট নিয়ে টিভি ধারাভাষ্যকাররা আলোচনা করার সময় ক্যামেরা তাকে ফোকাস করলে তিনি অশালীনভাবে বাজে ইঙ্গিত করেন। একই বছর ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে তার স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে একজন দর্শককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন।
২০১৫ সালে বিপিএল চলাকালে একাধিকবার আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। স্ট্যাম্পে লাথি এবং স্ট্যাম্প তুলে মাটিতে আছাড় মেরেছেন। এ কারণে ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো একবার তাকে ‘ব্যাড বিহেভিয়ার কিং’ হিসেবে অভিযুক্ত করে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্দেশ অমান্য, জুয়াড়ির কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব গোপন করা, কোনো কোনো সফরে খেলতে না যাওয়া, জৈব সুরক্ষা বলয় ভঙ্গ, শেয়ার কারসাজির তদন্তে নাম থাকা, দুবাইয়ে খুনের আসামির দোকান উদ্বোধন করতে যাওয়া, খেলার চেয়ে বিজ্ঞাপনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়াসহ তার বিপক্ষে অভিযোগের শেষ নেই। এ কারণে অনেকবার নিষিদ্ধ হয়েছেন। অর্থ জরিমানা দিয়েছেন। একাধিকবার ক্ষমাও চেয়েছেন।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, যখনই তাকে নিয়ে সমালোচনার তীব্র ঝড় ওঠে, প্রায় প্রতিবারই মাঠে নেমে বাজিমাত করে দেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি খেতে হয়।’ এ কারণেই অনেক অনিয়ম, অন্যায় ও অশালীন আচরণ করার পরও সাকিব দর্প নিয়ে চলতে পারেন। এমনটা বোধ করি আর কোনো ক্রিকেটারের পক্ষে সম্ভব হবে না।
খেলার মাঠ থেকে অবসর না নিলেও রাজনীতির মাঠেও যোগ দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। যোগ দিয়েই কেল্লাফতে করেছেন। হয়েছেন সংসদ সদস্য, যা একজন রাজনীতিবিদের চির আরাধ্য। অথচ রাজনীতি হলো একটি কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে সোপানে পৌঁছাতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুসারে, জনজীবনে রাজনীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমাজের ব্যক্তিবর্গের জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতিক মতাদর্শ ও সিদ্ধান্তগুলোর মধ্য দিয়ে। সমাজজীবনে তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত বিষয়াদির মাধ্যমে রাজনীতির এলাকা নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বভাবতই রাজনীতির অর্থ, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। এটা সহজ-সরল কোনো পথ নয়। অনেক আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়ে রাজনীতিক হিসেবে সাফল্য পাওয়া যায়। অবশ্য জনপ্রতিনিধি হতে হলে লোকপ্রিয়তা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
রাজনীতিবিদ হওয়ার আগেই জনপ্রিয়তা অর্জন করায় সাকিবের সংসদ সদস্য হওয়ার পথটা সুগম হয়েছে। জনপ্রতিনিধি একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বহন করেন। তার যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর নির্ভর করে কোনো সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ। সংসদ সদস্য হিসেবে সাকিবের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিশ্চয়ই তিনি ধীরে ধীরে রপ্ত করে নেবেন। খেলোয়াড় হিসেবে অনেক উল্টা-পাল্টা করলেও রাজনীতিক হিসেবে তেমনটা গ্রহণযোগ্য হবে না। রাজনীতি তো মানুষকে নিয়ে। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-সুবিধার দিকে নজর রাখা এবং সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হতে হয়। সাকিব তার এলাকার মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে জনগণের আস্থা, ভালোবাসা ও সমর্থন অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে সাকিব কী করতে পারবেন, সেটা জানা যাবে অদূর ভবিষ্যতে। তবে জাতীয় সংসদের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার সময় তার বিরুদ্ধে মেজাজ হারিয়ে একজন কর্মীকে চড় মারার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। যথারীতি সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে এ ঘটনাকে নানাভাবে চাউর করা হয়েছে। যা একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত। বিষয়টি হয়তো তার কাছে সামান্য হতে পারে; কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এ ধরনের ঘটনা তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। হয়তো তাকে এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তাতে তিনি অভ্যস্থ নন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেলফি তোলা কিংবা অটোগ্রাফের জন্য তাকে ছেঁকে ধরা হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে ছোটখাটো নিগ্রহ সইতে হয়। ভক্ত-অনুরাগীকে তাকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন বলেই এমনটি হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে তাকে বিচক্ষণ ও ধৈর্যশীল হতে হবে।
রাজনীতির মাঠ তো কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আদর্শবাদী ও ন্যায়নিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা পুরো জীবন মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেছেন। কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা না করে জেলজুলুম খেটেছেন। অত্যাচার সয়েছেন। সাকিব তো জেনেশুনেই রাজনীতিতে নেমেছেন। খেলার মাঠে তিনি যেভাবে সাফল্য পেয়েছেন, রাজনীতির মাঠে সাফল্য পেতে হলে তাকে আরও বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে খেলার মাঠে দূরত্ব বিপরীতমুখী হলেও ইচ্ছে, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকলে রাজনীতিবিদ হিসেবে সফল হতে পারবেন। সেক্ষেত্রে তাকে জনবান্ধব হতে হবে। মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে। তাদের মনের কথা শুনতে হবে। ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব আল হাসান যে সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তেমনটা করতে পারলে তিনি একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বদলাতে হবে। সাকিব কি নিজেকে বদলাতে পারবেন?
লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে