কারিগরী বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কারিগররা কি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে!
দেখেশুনে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, বাংলাদেশ আসলে দুর্নীতিবাজদের স্বর্গরাজ্য। একজন সৎ লোকের পক্ষে টিকে থাকাই মুশকিল। কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি জীবনেও ঘুষ খাবেন না; তাহলে পাশের টেবিলের সহকর্মীরাই তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবেন। নিজেদের ঘুষ খেতে অসুবিধা হবে বলে, তাকে সরানোর চেষ্টা করবেন। দেখা যাবে, ঘুষ না খাওয়া কর্মকর্তার চাকরি যাবে দুর্নীতির অভিযোগে। কোনো কোনো অফিসে ঘুষের রেট বাধা আছে। ঘুষ আসবে, সেটা আনুপাতিক হারে ভাগ হয়ে যাবে। কম বেশি সবাই ভাগ পাবে। এর মধ্যে কেউ যদি ঘুষ খেতে না চান, পুরো চেইনটা বিঘ্নিত হয়।
আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন, কাউকে ঘুষ দেবেন না; তাহলে আপনার জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। জন্মসনদ বলেন, পাসপোর্ট বলেন, এনআইডি বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স বলেন; ঘুষ ছাড়া সহজে কিছুই পাবেন না আপনি। পেলেও আপনার জীবন জেরবার হয়ে যাবে। ঘুষ দিলে এমনকি আপনি আপনার ডেথ সার্টিফিকেটও পেয়ে যাবেন, রোহিঙ্গা হলেও পাসপোর্ট পাবেন, ইচ্ছামতো এনআইডি বানাতে পারবেন।
আমাদের দেশে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, টাকা পাচারকারীদের দাপটই আলাদা। তাদের চেহারা নুরানী, গাড়ি দামি, বাড়ি আধুনিক। মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করে সমাজে আপনার আলাদা সম্মান। আপনার চলাফেরা উঁচু তলায়। কেউ আপনাকে দুর্নীতিবাজ বলতেই ভয় পাবে। অনেক টাকা থাকলে আপনি রাজনীতি করতে পারবেন, মনোনয়ন কিনতে পারবেন, এমপি হতে পারবেন, কপাল ভালো হলে মন্ত্রী হতে পারবেন। পদ্মা ব্যাংক বা বেসিক কারা লুট করেছে সবাই জানে। তাদের কি কিছু হয়েছে? হয়নি, হবেও না। তাদের লুটপাট ঢাকতে এখন পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ লুটপাটে জেরবার ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা হচ্ছে। মার্জ করেন অসুবিধা নেই, কারা ব্যাংকগুলোকে ফাঁকা করে ফেলল, তাদের আগে ধরেন।
বাংলাদেশে সব সেক্টরেই দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। মাঝে মাঝে একেক প্রতিষ্ঠানের নাম সামনে আসে। কখনো বিআরটিএ, কখনো পাসপোর্ট অধিদপ্তর, কখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম সামনে আসে। এবার এসেছে কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের নাম। আগেই যেমন বলেছি, টাকা দিলে আপনি সব পাবেন, এমনকি আপনার নিজের ডেথ সার্টিফিকেটও। নীলক্ষেতে সব ধরনের সার্টিফিকেট কিনতে পাওয়া যায় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। তবে কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের সনদ বাণিজ্যটা অভিনব। নকল কিন্তু আসলের মতো। ৩০-৩৫ হাজার টাকা দিলেই আপনি পেয়ে যাবেন একদম আসলের মতো নকল সনদ। ধরার কোনো উপায় নেই। সনদ দেওয়া হবে বোর্ডের আসল শিটে এবং সেটা আপলোড করা হবে বোর্ডের ওয়েবসাইটে। ফলে ধরবেন কীভাবে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা হলে ধরা সত্যিই মুশকিল।
এই সনদ বাণিজ্যের মূল হোতা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান। তার তাতেই যেহেতু বোর্ডের ওয়েকসাইটের মূল চাবিকাঠি। তাই সার্টিফিকেট বা মার্কশিট বানানো তার জন্য ডালভাত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে সার্চ দিলে এসব ভুয়া নম্বরপত্র ও সনদ আসল হিসেবেই দেখা যায়। বোর্ডের গোপন কক্ষ থেকে এসব সনদের ফাঁকা সিট এনে নিজের বাসায় বসে সেগুলো পূরণ করতেন শামসুজ্জামান।
গত কয়েক বছরে তিনি এমন ৫ হাজার সনদ বিক্রি করেছেন। তার মানে কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন তিনি অনায়াসে। এই শামসুজ্জামানকে ধরার পর এখন একে একে বেরিয়ে আসছে থলের বেড়াল তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী শেহেলা পারভীনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অব্যাহতি দেয়া হয়েছে আলী আকবর খানকেও। তাকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আলী আকবর খানের চেহারা দেখে আমি চমকে গেছি। এমন নুরানী চেহরার একজন মানুষ কী করে এমন অন্যায় করতে পারেন বা এমন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে পারেন।
শামসুজ্জামান একাই সনদ বাণিজ্য করেছেন, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। পুলিশের কাছে এই চক্রে জড়িত আরও অনেকের নাম বলেছেন তিনি। সবাই মিলে মিশেই দুর্নীতি করেছেন। সেই দুর্নীতি ঢাকতে আবার ঘাটে ঘাটে টাকা ঢেলেছেন। তার দেয়া হিসাব অনুযায়ী খালি মুখ বন্ধ রাখতেই তিনি ২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ২০ কোটি কামাই করতে পারলে ২ কোটি টাকা ঘুষ দেয়া কোনো বিষয়ই না। এর আগে ২০১৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে শামসুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়; কিন্তু ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে তদন্ত আটকে চাকরিতে পুনর্বহাল হন তিনি। শামসুজ্জামান পুলিশের কাছে এই চক্রের অন্তত ২৫ জনের তালিকা দিয়েছেন। ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে সনদ বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়টি জানতেন দুর্নীতি দমন কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কম্পিউটার কাউন্সিলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও শিক্ষা বিটের সাংবাদিকরা। কাউকে ৪০ লাখ, কাউকে ৩০ লাখ, কাউকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে তিনি সব ম্যানেজ করেছেন এবং আবার বিপুল উদ্যমে সনদ বাণিজ্য চালিয়ে গেছেন।
শামসুজ্জমান পুলিশের কাছে তার কাছ থেকে টাকা নেয়া কয়েকজন সাংবাদিকের নামও বলেছেন। কে কত টাকা নিয়েছেন তাও বলেছেন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক নেতাও আছেন।
সাংবাদিক নেতার নাম চলে আসায় এবং সেটা প্রচার হওয়ায় সাংবাদিকদের কেউ কেউ আবার গোস্বাও করেছেন। অভিযুক্ত একজনের বক্তব্য যাচাই বাছাই ছাড়া এভাবে প্রচার করা সঙ্গত কি না, সাংবাদিকতার এথিক্সের সঙ্গে যায় কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। আমি তাতের গোস্বার সঙ্গে একমত। যাচাই-বাছাই ছাড়া ঢালাও অভিযোগ প্রচার করে দেয়া আসলেই সঙ্গত নয়। একজন তো ইচ্ছা করে আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারে। সেই অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হতে হতে অভিযুক্তের সামাজিক অবস্থান ধুলায় মিশে যাবে; কিন্তু কথাটা হলো বছরের পর বছর আমরা সাংবাদিকরা এই অসঙ্গত কাজটা করে আসছি। পুলিশের বক্তব্য কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রচার করছি। ট্রায়ালের চেয়ে ভয়ংকর মিডিয়া ট্রায়াল। আজ নিজেদের এসেছে বলে আমাদের গায়ে লাগছে। শামসুজ্জামান যাদের নাম বলেছেন, তারা সত্যি সত্যি টাকা নিয়েছেন কি না জানি না। তবে সাংবাদিকদের কেউ কেউ যে এমন ঘুষ নেন, দুর্নীতি করেন, নিউজ করে দেয়ার কথা বলে ব্ল্যাকমেইল করেন, নিউজ করার জন্য টাকা নেন, নিউজ ধামাচাপা দেয়ার জন্য টাকা নেন; এটা তো আর মিথ্যা নয়।
আমরা না প্রচার করলেই তো আর এ অভিযোগ মিথ্যা হয়ে যাবে না। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা জানি না; কিন্তু শামসুজ্জামান কীভাবে কর্মস্থলসহ তাদের নাম জানলেন। তার মানে শামসুজ্জামানের সঙ্গে তাদের কোনো না কোনো যোগাযোগ তো ছিলই। পুলিশের দায়িত্ব শামসুজ্জামান যাদের নাম বলেছে, তাদের সবার ব্যাপারে তদন্ত করা। সত্য হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া। মিথ্যা হলে সেটাও জানিয়ে দেয়া। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কর্মস্থলেরও দায়িত্ব তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করা। সাংবাদিকদের ভাবমূর্তির স্বার্থেই এটা করা দরকার। অভিযোগ আড়াল করে রাখলেই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। অভিযোগ নিষ্পত্তি করলেই বরং ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন হয়।
শামসুজ্জামান যা বলেছেন, সত্যিকার অর্থে তা দুর্নীতির বিশাল হিমশৈলের চূড়ামাত্র। পুলিশ চাইলে গভীরে যেতে পারে। শামসুজ্জামান তো একা নন। আমাদের চারপাশে এমন আরো অনেক শামসুজ্জামান আছে। সবাইকে ধরা উচিত; কিন্তু আমি জানি কিছুই হবে না। মাঝে মাঝে দুয়েকজন হয়তো আটকে যাবে। বাকি দুর্নীতিবাজরা বরাবরের মতোই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে।
লেখক: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে