Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

হকিতে কি ফুটবে ‘সম্ভাবনার ফুল’!

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রত্যাশা প্রাপ্তির সংযোগ ঘটলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার প্রসঙ্গ চলে আসে। জুনিয়র এশিয়া কাপের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ হকির যুব বিশ্বকাপে পা রাখার পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে কিন্তু বিপদ। বিপদের এ মাত্রা রিখটার স্কেলে মাপা যাবে না, ব্যারোমিটারে বোঝা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে সামনে আসছে নারী বিভাগে জুনিয়র এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচ। যাতে অর্পিতা পালদের ১৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে চীন। বিশ্বকাপ মঞ্চে পরাশক্তিরা কিন্তু তার চেয়েও নির্দয় হবে! সুতরাং বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে- এটা খুশির সংবাদ। এ খুশিতে আত্মহারা হয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে ওঠার আগে যেন আমরা দলটা সঠিকভাবে প্রস্তুত করার বিষয় ভুলে না যাই।

জুনিয়র এশিয়া কাপ খেলে আসা দলটির অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় তুলে ধরাকে উৎসবের মাঝে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হতে পারে। তারপরও সে গীত গাওয়া জরুরি। অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো, দলের অসঙ্গতি সবার জানা উচিত, যার ভিত্তিতে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে দল প্রস্তুত করতে ক্রীড়া প্রশাসনও উদ্যোগ নিতে পারে। ওমানের মাসকাটে সদ্য সমাপ্ত আসরে বাংলাদেশ স্কোয়াডের পরিধি ছিল ২১ জনের। ১৮ খেলোয়াড়ের সঙ্গে কোচ মওদুদুর রহমান শুভ, ম্যানেজার কাওসার আলী এবং ফিজিও। আধুনিক হকির তুলনায় দলের সাপোর্টিং স্টাফের এ সংখ্যা কেবল কম নয়, বিস্ময়কর বটে!

কী কারণে বিস্ময়কর সেটা বর্ণনা করা যাক। বর্তমান বিশ্ব হকি পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। প্রতিপক্ষ দল, দলের খেলোয়াড় এবং সে দলের বিভিন্ন ম্যাচের তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা সাজাতে হয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রধান কোচের সঙ্গে একাধিক সহকারী থাকে। সহকারী রাখা হয় ম্যানেজারের সঙ্গেও। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে ভিডিও বিশ্লেষক, ফিজিও এবং ট্রেইনার; কিন্তু বাংলাদেশ দলের ফিজিওর কাজ বাদ দিয়ে বাকি দায়িত্বগুলো পালন করেছেন কোচ মওদুদুর রহমান শুভ এবং ম্যানেজার কাওসার আলী। এ কাজ করতে গিয়ে কখনো কাওয়ার আলী নিজেই প্রতিপক্ষ দলের ভিডিও ধারণ করেছেন। সেটা একযুগ আগে কেনা পুরোনো ক্যামেরা দিয়ে। বর্ষীয়ান এ হকি এক্সপার্ট সে ক্যামেরা দেশ থেকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে গিয়েছিলেন। সব ম্যাচের ভিডিও তো ধারণ করতে পারেননি। ফুটেজ সংগ্রহ করতে অনেক সময় বিভিন্ন দেশের ভিডিও বিশ্লেষকের দ্বারস্ত হয়েছেন। এভাবে সংগ্রহ করা কাটা-ছেঁড়া ভিডিও বিশ্লেষণ করেই পরিকল্পনা সাজিয়েছে বাংলাদেশ। সে পরিকল্পনা লাল-সবুজদের বিশ্বকাপ মঞ্চে নিয়ে গেছে।

এখন আপনি যদি ভাবেন এভাবে কাটা-ছেঁড়ার পরিকল্পনা এবং জোড়াতালির দল নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাবেন; সেটা যেতেই পারেন। যাওয়ার আগে প্রতিপক্ষের হাতে নাকাল হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। সেটা নারী দলের মতো ১৭-০ গোলের চেয়ে বড় বিপর্যয়, নাকাল হওয়ার উপলক্ষ ডেকে আনতে পারে। এ কারণেই হকি সংশ্লিষ্টরা আকুতি জানাচ্ছেন- দ্রুতই এ দলটাকে প্রস্তুত করার দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত। কারণ যুব দলের এ কীর্তিটাকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ হকিতে এমন টার্নিং পয়েন্ট অবশ্য অতীতে ধারাবাহিকভাবেই এসেছিল। যার সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে, পরিণত হয়েছে হতাশায় অধ্যায়ে।

১৯৮৫ সালের এশিয়া কাপের পর দেশে না কি হকি বিপ্লব ঘটেছিল। গাছের ডাল দিয়েও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হকি খেলার চিত্র দেখা গেছে। সেটা হারিয়ে যেতে সময় লাগেনি। রফিকুল ইসলাম কামালরা বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন বিশ্বকাপ স্বপ্ন নিয়ে। পরে সিনিয়র পর্যায়ে আলোচিত সাদেক-কামাল জুটি গড়েছেন। বিশ্বকাপ সংক্রান্ত সম্ভাবনার ফুল ফোটাতে পারেননি। ২০০৪ সালে জাহিদুল ইসলাম রাজনের নেতৃত্বে জাহিদ হোসেন-মশিউর রহমান বিপ্লবরাও বড় স্বপ্ন দেখেছেন, দেশবাসীকে দেখিয়েছেন। স্বপ্নটা বাস্তবের জমিনে নেমে আসেনি। ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড হকি লিগ রাউন্ড-টু দিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেছে বাংলাদেশ; কিন্তু সেটাও ফিকে হতে সময় লাগেনি। ওমানে অনুষ্ঠিত জুনিয়র এশিয়া কাপ হকিতে বিশ্বকাপ সংক্রান্ত আক্ষেপ ঘুচিয়েছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে এটা বাংলাদেশ হকির টার্নিং পয়েন্ট। সেটা কাজে লাগিয়ে আদৌ দেশের হকি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তো!

এ জন্য সমন্বিত উদ্যেগ, দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নাই। সে উদ্যেগ, পরিকল্পনার কেন্দ্রে বসে আছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকিএসপি)। এ লাইনটা পড়ে যারা ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন, তাদের অবগতির জন্য বলছি- বাংলাদেশকে বিশ্ব মঞ্চে নিয়ে যাওয়া দলটির ১৮ খেলোয়াড়ের সবাই কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে উঠে এসেছেন। স্কোয়াডের ১৪ জন বিকেএসপির সাবেক ছাত্র, ৪ জন বিকেএসপির বর্তমান ছাত্র। এমনকি কোচের দায়িত্ব পালন করা মওদুদুর রহমান শুভও প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত। ম্যানেজার কওসার আলী বিকেএসপির সাবেক কোচ। তার ছাত্ররাই এখন প্রতিষ্ঠানটির হকি বিভাগে পরিচালনা করছেন। এখানেই শেষ নয়। ওমান খেলতে যাওয়ার আগে বিকেএসপিতে আবাসিক ক্যাম্পের সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দলটা প্রস্তুত করা হয়েছে।

এ কারণেই সাবেক কর্মস্থলকে কৃতিত্ব দিলেন যুব দলের ম্যানেজার কাওসার আলী, ‘আমাদের কপাল ভালো যে, দেশে বিকেএসপির মতো একটা প্রতিষ্ঠান ছিল। যার সুন্দর একটা ক্যাম্পাস আছে। আছে নানা সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কাঠামো। যেটা ব্যবহার করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রেখেছে।’ কাওসার আলীর মতে, এখন থেকে পরিকল্পনা না সাজালে বিশ্বকাপ-সংক্রান্ত উচ্ছ্বাস দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে সময় লাগবে না। তিনি বলছিলেন, ‘ওমান থেকে দেশে ফেরার পর আমি হকি ফেডারেশনের সংশ্লিষ্টদের বলেছি, ছেলেদের এক-দুই সপ্তাহ বিশ্রাম দিন। তারপর থেকে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু করুন। অন্যথায় বিশ্বকাপ মঞ্চটা কিন্তু আমাদের জন্য লজ্জার অধ্যায় হয়ে থাকতে পারে।’

বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। বিশ্বকাপ খেলতে হবে ঠিক এক বছর পর- ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। সে আসরের আগে সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাজানোর কথা বলছেন। এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখায় রাখা জরুরি যে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান দলটির অনেক সদস্য হয়তো বয়সের কারণে যুব বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় রাখতে হবে নতুনদেরও। যে খেলোয়াড়দের দেশের এবং দেশের বাইরে নিয়মিত ম্যাচ খেলিয়ে প্রস্তুত করা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ হকিতে সমস্যার অন্ত নেই। প্রধান সমস্যা মনে করা হয় সংগঠকদের মধ্যেকার বিরোধকে। যে কারণে টার্ফের কার্যক্রম বারবার আক্রান্ত হয়। যা দেশের হকিকে নিয়মিত পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবেই বঞ্চিত হচ্ছেন খেলোয়াড়রা। সে বিরোধ মেটাতে বিগত দিনে ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে লে. কর্নেল (অব.) রিয়াজুল হাসানকে; কিন্তু এ সংগঠক আদৌ অচলায়তন ভাঙতে পারেন কি না- সময়ই বলবে। অচলায়তন ভেঙে যুব হকি দলের সদস্যদের জন্য খুলে দেয়া উচিত ইউরোপে দুয়ার। জুনিয়র এশিয়া কাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লিগ খেলার পাশাপাশি প্রস্তুতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল; কিন্তু সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। এ নিয়ে ব্লেম-গেম চলেছে ক্রীড়াঙ্গনে। এক সংগঠক দোষারোপ করেছেন আরেকজনকে। ব্লেম-গেমে কপাল পুড়েছে খেলোয়াড়দের।

ইউরোপ সফর একদিকে খেলোয়াড়দের আর্থিক সুফল এনে দেবে, অন্যদিকে উন্নত প্রশিক্ষণে বিশ্বকাপ মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে; কিন্তু জার্মান কোচ গেরহার্ড পিটার বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ ছাড়ায় ইউরোপের দুয়ার খোলার কাজটাও কঠিন। কারণ বর্ষীয়ান এ কোচই বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের ইউরোপের পথ চিনিয়েছিলেন। যার সুফল হিসেবে ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড হকি লিগে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিল রাসেল মাহমুদ জিমি, মামুনুর রহমান চয়ন, মশিউর রহমান বিপ্লব, জাহিদ হোসেন, কামরুজ্জামান রানা, ইমরান হোসেন পিন্টুরা; কিন্তু দেশের হকির আভ্যন্তরীন নানা ঘটনার সঙ্গে গেরহার্ড পিটার যেভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাতে আদৌ সে পথটা খোলার সম্ভাবনা আছে তো!

দেশের বাইরে হোক কিংবা দেশে- যেভাবেই হোক এ দলটাকে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা জরুরী। কারণ এ দলে রকিবুল হাসান রকি, আমিরুল ইসলাম, হুজাইফা হোসেন এবং মোহাম্মদ নয়নের মতো জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতাপুষ্ট খেলোয়াড় যেমন আছেন। আছেন হাসান, তৈয়ব এবং অভির মত তরুণ খেলোয়াড়; যারা এখনও বিকেএসপিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনা করছেন হুজাইফা হোসেনও। ২০২৫ সালের যুব বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দল প্রস্তুত করা হলে তা আগামীর জাতীয় দলকে উজ্জ্বল করবে সন্দেহ নেই; কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যুব বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার পর হকি কেন্দ্রীক সম্ভাবনার ফুল ফোটাতে পারবে তো বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক লে. কর্নেল (অব.) রিয়াজুল হাসান কিন্তু আশাবাদী, ‘যুব বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা দলটিকে আরও উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করার জন্য আমরা এরই মধ্যে ফেডারেশনের সভাপতির (বাংলাদেশ বিমান বাহিনীপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান) সঙ্গে আলোচনা করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা নিজেরাও নানাভাবে চেষ্টা করছি। আশা করছি, বাংলাদেশ দলকে ভালোভাবে প্রস্তুত করেই বিশ্বকাপ খেলতে পাঠাতে পারব।’

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ