এলএনজির স্পট মার্কেট ঝুঁকি কি থেকেই যাচ্ছে
দেশের প্রধান জ্বালানি গ্যাস। দেশীয় খনি থেকে উত্তোলনের পাশাপাশি এখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হয়। গত চার বছর ধরে সরবরাহ করা গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ আসে এলএনজি থেকে। ক্রমান্বয়ে সরকার আমদানি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে। বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানে তেল গ্যাস না পাওয়া গেলে আমদানির কোনো বিকল্পও নেই; কিন্তু আমদানির কোন উৎসটি নিরাপদ, সেটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ জরুরি। প্রশ্ন উঠেছে সেই জায়গাতে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি!
আমদানির মূলত দুটি উৎস রয়েছে। একটি হচ্ছে স্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে আমদানি। অন্যটি হচ্ছে খোলাবাজার থেকে আমদানি। বাংলাদেশে এখন স্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে কাতার এবং ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের স্পট মার্কেট থেকে খোলা বাজারের এলএনজি কেনে বাংলাদেশ।
স্থায়ী চুক্তির যে দাম তা পূর্বনির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট করা থাকে। তেলের দামের ওপর নির্ভর করে ওই দাম ঠিক করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে স্পট মার্কেট বা খোলা বাজারের দাম নির্ধারিত হয় চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ যখন চাহিদা বেড়ে যায়, তখন দামও বেড়ে যায়। আবার চাহিদা কমলে দাম কমে যায়। কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে স্পট মার্কেটের এলএনজির দাম বেড়ে যায়। আবার ইউক্রেন এবং রাশিয়া যুদ্ধের পর আরও এক দফা ধাক্কা লাগে। ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন এশিয়ার দেশগুলোর জ্বালানিতে পশ্চিমারা ভাগ বসায়। ওই সময় প্রতি এমএমবিটিইউ (এলএনজির একক) দাম ৬ থেকে ৭ ডলার থেকে এক সর্বোচ্চ ৫৬ ডলারে উঠে যায়। ঠিক ওই সময়ে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি কেনা হয়েছে ১২ থেকে ১৩ ডলারে। তখন এলএনজির দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির ওপর সরকার জোর দিলেও এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। এর মধ্যে ওমানের সঙ্গে মাত্র একটি দীর্ঘ মেয়াদি এলএনজি ক্রয় চুক্তি হয়েছে। তবে এখনো ওই চুক্তির আলোকে এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়নি।
পেট্রোবাংলা সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগে আগামী ছয় মাসের এলএনজি সরবরাহ প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এতে দেখা যায়, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চাইতে স্পট মার্কেটের প্রাধান্য বেশি। পেট্রোবাংলার হিসাব বলছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে মোট ৪৯ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হবে।
চলতি এপ্রিল মাসে দৈনিক ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন এবং স্পট মার্কেট থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হবে। আগামী মে এবং জুন দুই মাসেই প্রতিদিন সরবরাহ করা এলএনজির মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে স্থায়ী চুক্তি থেকে আর ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটই আসবে স্পট মার্কেট থেকে। জুলাই মাসে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে। অন্যদিকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে স্পট মার্কেট থেকে। আগস্টে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে স্থায়ী চুক্তি থেকে অন্যদিকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে স্পট মার্কেট থেকে। সেপ্টেম্বরে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি থেকে অন্যদিকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট আসবে স্পট থেকে। অর্থাৎ আগামী ৬ মাস দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির তুলনায় বেশি এলএনজি আসবে স্পট মার্কেট থেকে।
এখন স্পট মার্কেটে অবশ্য এলএনজির দাম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চাইতে কিছুটা বেশি পড়ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে ৯ দশমিক ৬১২ ডলারে কেনা হচ্ছে। অন্যদিকে কাতার থেকে প্রতি এমএমবিটিইউ কেনা হচ্ছে ১০ দশমিক ৭৭১ ডলারে এবং ওমান থেকে কেনা হচ্ছে ১০ দশমিক ০৬ ডলারে।
এখন দামের হিসাব বিবেচনা করলে স্পট মার্কেট খানিকটা স্বস্তি দিচ্ছে। তবে ইরান-ইসরায়েল টেনশন এই স্বস্তি কতক্ষণ থাকতে দেবে তা বলা মুশকিল। তা ছাড়া শীতের সময় পশ্চিমা দেশগুলোতে জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ সময় স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম চড়া থাকে। ফলে এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিই আমাদের জন্য ভালো। এতে এলএনজি সরবরাহ পাওয়ার যেমন নিশ্চয়তা থাকে, তেমনি অস্বাভাবিক বেশি দামে এলএনজি কিনতে হয় না।
বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরও বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য এখন মাতারবাড়ীতে যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে, তার বাইরেও আরও দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে একটি অস্থায়ী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল। অন্যদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল। ইতোমধ্যে দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানিকে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের আলোচনাও খানিকটা এগিয়েছে। প্রকল্পটির জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে পায়রাতে আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে টার্মশিট সই করা হয়েছে। ফলে আগামী দুই বছরের মধ্যে অন্তত আরও ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের; কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বড় কোনো এলএনজি সরবরাহকারী দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে পারেনি সরকার। সম্প্রতি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশ সফরে আসেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ ছিল এই সফরে আমিরের সামনে এলএনজি আমদানি প্রসঙ্গে উত্থাপন করার; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কাতার এই আলোচনায় সম্মত হয়নি।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যেসব দেশ এলএনজি সরবরাহ করে বাংলাদেশ এর মধ্যে কাতার এবং ওমানের সঙ্গে চুক্তি করতে পেরেছে। তবে এর বাইরে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এমন চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে