Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আবাহনী ক্লাবের ট্রফি ও স্মৃতিচিহ্ন আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে?

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

মেরিকান ডিগার’ ছিল ডিসকভারি নেটওয়ার্কে প্রচারিত জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি সিরিজ। রিক স্যাভেজ নামে পরিচিত সাবেক পেশাদার কুস্তিগির ফ্রাঙ্ক হুগুলেট এবং তার প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান স্যাভেজ’-এর স্টাফরা প্রত্নবস্তুর খোঁজে বিভিন্ন স্থান চষে বেড়াতেন। প্রত্নবস্তুর খোঁজে মাটি খুঁড়তে রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে বিভিন্ন পর্বে। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রাচ্যের দেশগুলোর প্রচেষ্টার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল জনপ্রিয় ওই টিভি সিরিজে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহও ছিল ব্যাপক। ওই সিরিজের মাধ্যমে বোঝা গিয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। গুরুত্ব পায় ক্রীড়া-ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সংরক্ষণের বিষয়গুলোও। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অগ্রসর দেশগুলোর ক্লাব কালচার সমৃদ্ধ; যেখানে ক্লাবগুলোর ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।

বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের চিত্রটা ঠিক উল্টো, বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে আপনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যই খুঁজে পাবেন না। দেশের ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা কে? এমন প্রশ্ন করা হলে হয়তো একাধিক ফুটবলার এসে হাজির হবেন- দাবি করবেন আমিই বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করেছি! যার পক্ষে প্রমাণাদি পাওয়া দুষ্কর! দিন শেষে আপনি সঠিক উত্তরটা আর খুঁজে পাবেন না। কারণ ফুটবলের এসব তথ্য-উপাত্ত কোথাও সংরক্ষণ করা হয়নি। এমনকি দেশের অর্ধশত জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের অধিকাংশই ঘরোয়া কার্যক্রমের সঠিক তথ্য কিংবা পরিসংখ্যান দিতে পারবে না। তথ্যের মতো ক্লাবগুলোর অর্জন এবং নানা স্মৃতিচিহ্নও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। চরম উদাসিনতার ফাঁক গলে কিছু ট্রফি এবং নানা স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়েছিল বিভিন্ন ক্লাবে। নানা সময়ে ক্লাবগুলো আক্রান্ত হওয়ায় সেসব স্মৃতি চিহ্নও উধাও! ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং নানা স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেয়ার সর্বশেষ নজির আবাহনী ক্লাবে দুর্বৃত্তদের হানা।

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেছেন। তার কয়েক ঘণ্টা পর আক্রান্ত হয় ধানমন্ডিপাড়ার ক্লাব আবাহনী। দুর্বৃত্তরা অস্থায়ী ক্লাব ট্যান্টের আটটি কক্ষে হামলা চালায়। তাতে চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, অর্থ এবং অন্যান্য আসবাব লুট হয়ে গেছে। এ ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে নেওয়া যাবে; কিন্তু লুটেরার দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনপ্রিয় ক্লাবটির সব অর্জনের নানা স্মৃতিচিহ্ন এবং ট্রফিও নিয়ে গেছে, যা অপূরণীয় ক্ষতি। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ছাড়াও টেবিল টেনিসের মতো অন্যান্য ডিসিপ্লিনেও আবাহনীর বিচরণ ছিল। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের সাফল্যর অনেক স্মারকই ক্লাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। যেগুলো সংরক্ষিত ছিল, লুটপাটের পর তা এখন স্মৃতির অ্যালবামে ঠাঁই করে নিয়েছে! হামলা ও লুটপাটের পর কয়েকটা ট্রফি বিভিন্ন ব্যক্তির মারফত ফিরে পেয়েছে আবাহনী ক্লাব; কিন্তু অধিকাংশ ট্রফির এখনো হদিস নেই।

আক্রান্ত হয়েছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব এবং পুরান ঢাকার ঊষা ক্রীড়াচক্র। দুর্বৃত্তায়নে আক্রান্ত প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের ক্লাব ফরটিজ এফসিও। ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ক্লাবটির একাডেমির ফুটবলারদের যাতায়াতে ব্যবহার করা বাসে। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, ঊষা ক্রীড়াচক্র এবং ফরটিজ এফসিতে হামলা ও ভাঙচুর করা হলেও ট্রফি চুরির খবর পাওয়া যায়নি।

লুট করা হয় ক্লাবের ৫২ বছরের ইতিহাসে পাওয়া অমূল্য ট্রফিগুলো

হামলার পর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে সম্প্রতি আবাহনীর সাবেক-বর্তমান ক্রীড়াবিদরা ক্লাব প্রাঙ্গণে একত্রিত হয়েছিলেন। বহরে ছিলেন আবদুস সাদেক, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আব্দুল গাফফার, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, খালেদ মাহমুদ সুজন, গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, দিপু রায় চৌধুরীরা। সকলে সমস্বরে আকুতি জানিয়েছেন, ‘ঐতিহ্যের ধারক ট্রফিগুলো দয়া করে ফেরত দিয়ে যান।’ এ সময় নিশ্চিত করা হয়, ক্লাবে ট্রফি ফেরত দিতে এসে কেউ কোনো ধরনের জটিলতায় আক্রান্ত হবে না। এ আহ্বান এবং নিশ্চয়তার পরও খুব বেশি সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কী করার আছে আকাশি-হলুদ সংশ্লিষ্টদের!
ক্লাবগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক, দীর্ঘদিনের অর্জনের স্মৃতিচিহ্ন হারানো কিন্তু এটিই প্রথম নয়।

ক্যাসিনোকাণ্ডের পর আরামবাগের বেশকিছু ক্লাব দীর্ঘদিন সিলগালা অবস্থায় ছিল। ২০১৯ থেকে ২০২৩- প্রায় চার বছর ওই অবস্থায় ছিল বেশ কয়েকটি ক্লাব। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে খোলা হয় ক্লাবগুলোর তালা; কিন্তু বিভিন্ন ক্লাবের অবস্থা দেখে চোখ রীতিমতো কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। ঢাকা ওয়ান্ডারারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়াংমেন্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়াসংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। ক্লাবের প্রধান ফটক খুলে দেখা যায় ভেতরে ধ্বংস্তূপ! ট্রফি এবং মূল্যবান জিনিসপত্র তো বটে ক্লাবের ফ্যান-লাইটও খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। একসময়কার পরাশক্তি ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাবিনেটে স্বাধীনতার আগের অনেক স্মৃতিচিহ্ন ছিল।

অতীতে মোহামেডানের ট্রফি-ক্যাবিনেট এভাবে আক্রান্ত হয়নি; কিন্তু সত্তরের দশকের শেষ দিকে অগ্নিকাণ্ড এবং সমর্থকদের রোষের মুখে অনেক ট্রফি হারিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির হকি ও ফুটবল দলের সাবেক সদস্য এবং বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা বলছিলেন, ‘ক্লাব ট্যান্ট একবার অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত হওয়ায় ট্রফি ছাড়াও অনেক স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে ওয়ারী ক্লাবের কাছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব হারের পর ক্ষুব্ধ সমর্থকরা ক্লাবে হানা দিয়েছিল। তখনো কিছু স্মৃতি ধ্বংস হয়েছে; যার অধিকাংশ ছিল স্বাধীনতার আগের।’

আবাহনী  ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়

১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাবে বর্তমানে খুব বেশি ট্রফি কিংবা অন্যান্য স্মারক সংরক্ষিত নেই। ১৯৯০ সালের আগে অর্জনের অধিকাংশ স্মৃতিচিহ্নের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্লাব ট্যান্টে পরিচালিত সংস্কারের সময়ও উধাও হয়ে গেছে অনেক ট্রফি। গোটা বিশ্বেই পুরোনো ক্লাবগুলোর ঐতিহ্যবাহী নানা স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে জাদুঘর তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে সে কালচার গড়ে ওঠেনি। ক্লাব ট্যান্টের এক কোণে অযত্ন-অবহেলায় যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছিল, নানা সময়ের দুর্বৃত্তপনায় সেগুলো উধাও হয়ে গেছে।

দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অর্জিত ট্রফিগুলো তো ক্রীড়াঙ্গনে অনুপ্রেরণা, জাতীয় সম্পদ। আবাহনীর সংগ্রহে ছিল, দেশের বাইরে থেকে অর্জিত নাগজি ট্রফি, চার্মস কাপ, বরদোলই ট্রফি ও ভারতের স্বাধীনতা কাপ। আজমিরী বেগম গোল্ডকাপ, বিটিসি ক্লাব কাপ, ডামফা কাপ, জাতীয় লিগ, ফেডারেশন কাপ, প্রিমিয়ার লিগ, সুপার কাপ, স্বাধীনতা কাপের মতো সাফল্যের স্মারক। আগা খান গোল্ডকাপ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অনেক স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত ছিল ক্লাবটিতে।

আবাহনী ক্লাব দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর হকির জীবন্ত কিংবদন্তি ও ক্লাবটির সাবেক পরিচালক আব্দুস সাদেক বলছিলেন, ‘বিগত ৫০ বছরে আবাহনী দেশের অন্যতম সেরা ক্লাব। বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে যে ট্রফি অর্জন করেছি- তার সংখ্যা আমি নিজেও জানি না। আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি- তিন ডিসিপ্লিনেই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী। পরে ক্লাবটি শত শত ট্রফি অর্জন করেছে; কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুদিন আগে ক্লাবের এসব স্মৃতিচিহ্ন কে বা কারা নিয়ে গেছেন। আমি গণমাধ্যমের মারফতে তাদের কাছে অনুরোধ করতে চাই, আপনারা ট্রফিগুলো ক্লাব প্রাঙ্গণে ফিরিয়ে দিয়ে যান।’

আবাহনী আক্রান্ত হওয়ার পর সাবেক তারকা ফুটবলার আব্দুল গাফফার বলছিলেন, ‘আমাদের অনেকের বয়সই এখন ষাটের ওপরে। আমরা চলে যাব; কিন্তু নতুন প্রজন্মের কেউই আবাহনীর ঐতিহ্যগুলো দেখতে পারবে না। তরুণদের কথা চিন্তা করে হলেও ট্রফিগুলো ফেরত দিয়ে যাবেন।’ আবাহনীর সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের ক্লাব ভাঙচুর করা হয়েছে, মহামূল্যবান ট্রফিগুলো নিয়ে গেছে- এটা শুনে মর্মাহত হয়েছি। ২০ বছর বয়সে ১৯৮০ সালে আমি আবাহনীতে খেলোয়াড় হিসেবে এসেছিলাম। বহু স্মৃতি জড়িয়ে এখানে, খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছি, সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছি। যারা এগুলো নিয়ে গেছেন, তারা ট্রফিগুলো ফেরত দিয়ে গেলে খুশি হবো।’

আব্দুস সাদেক, আব্দুল গাফফার, গাজী আশরাফ হোসেন লিপুদের আকুতি কি আদৌ সংশ্লিষ্টদের কানে পৌঁছাবে? আবাহনী কি ফিরে পাবে তার হারানো গৌরবের স্মারকগুলো- খুব বেশি কিন্তু আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না!

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ